সংসদের নকশা প্রকাশে নীতিমালা হচ্ছে
লুই আই কানের অনন্য সৃষ্টি জাতীয় সংসদ ভবন। স্থাপত্যের ভাষায় যাকে বলা হয় 'মাস্টার পিস'— বিশ্বের সেরা কয়েকটি স্থাপত্যের একটি। জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশাসহ গুরুত্বপূর্ণ দলিল, তথ্য-উপাত্ত, চুক্তি ইত্যাদি প্রকাশ করতে নীতিমালা তৈরি করেছে সংসদ সচিবালয়।
খসড়া নীতিমালাটি সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন পাস হওয়ার নয় বছর পর এ উদ্যোগ নিয়েছে সংসদ। সাংবাদিকসহ অন্য কেউ আবেদন করে সংসদের তথ্য-উপাত্ত নিতে পারবেন এ নীতিমালার মাধ্যমে।
তবে এটি চূড়ান্তের আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও জনমত যাচাইয়ের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, শুধু তথ্য উন্মুক্ত নয়, সেগুলো তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। তাহলে দুর্নীতি কমবে।
নীতিমালা তৈরির সঙ্গে জড়িত সংসদের গণ-সংযোগ- ১ এর পরিচালক তারিক মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নীতিমালাটি সংসদের সিনিয়র সচিব ড. মো. আবদুর রব হাওলাদারের কাছে জমা দিয়েছি। উনি বৈঠক করে এটি চূড়ান্ত করবেন। কবে এটি চূড়ান্ত হবে তা তিনিই বলতে পারবেন।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে লুই আই কানের করা জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটির মহাফেজখানা (আর্কাইভ) থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে নকশাগুলো প্রকাশের জন্য একটি নীতিমালা করার কথা বলেন। সেই থেকেই এ নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়।
জানা যায়, তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালা, ২০১৮ নামে নীতিমালাটি তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর আলোকে করা হচ্ছে। নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ সচিবালয় নাগরিকের তথ্য অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংসদ সচিবালয়ের যাবতীয় তথ্যের ক্যাটালগ এবং ইনডেক্স প্রস্তুত করে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবে। তবে যেসব তথ্য ফটোকপি বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেয়া হবে তার ব্যয়ভার যে তথ্য চাইবেন তাকে দিতে হবে।
কেন এই নীতিমালা
নীতিমালাটির মুখবন্ধে উল্লেখ আছে, এক সময় তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হতো। কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে সব তথ্যের অবাধ প্রকাশের পথ সুদৃঢ় হবে। এতে সংসদের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের বিস্তারিত জানার সুযোগ হবে।
এ নীতিমালা ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ কোন কোন উদ্দেশ্যে কী কী আইন তৈরি হচ্ছে- এসব তথ্যসহ সংসদ সচিবালয়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবেন।
নীতিমালার ধরা- ১ এ বলা হয়েছে, ‘তথ্য’ অর্থে সংসদ সচিবালয়ের আওতাধীন কার্যালয়সমূহের গঠন, কাঠামো ও দাফদরিক কর্মকাণ্ড-সংক্রান্ত যে কোনো স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগ বই, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অঙ্কিত চিত্র, ফিল্ম, ইলেক্ট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত যে কোনো উপকরণ, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য-নির্বিশেষে অন্য যে কোনো তথ্যবহ বস্তু বা এদের প্রতিলিপিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে দাফতরিক নোটশিট বা নোটশিটের প্রতিলিপি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।
কী কী প্রকাশ করবে না সংসদ
নীতিমালা অনুযায়ী অনেকগুলো বিষয়ে তথ্য দেবে না সংসদ। সেগুলো হলো-
(ক) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে এরূপ তথ্য;
(খ) পররাষ্ট্রনীতির কোনো বিষয় যার দ্বারা বিদেশি রাষ্ট্রের অথবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা আঞ্চলিক কোনো জোট বা সংগঠনের সহিত বিদ্যমান সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন তথ্য;
(গ) কোনো বিদেশি সরকারের কাছ হতে প্রাপ্ত কোনো গোপনীয় তথ্য;
(ঘ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে কোনো তৃতীয় পক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এরূপ বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক অন্তর্নিহিত গোপনীয়তাবিষয়ক, কপিরাইট বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য;
(ঙ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থাকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন তথ্য যেমন- অ) আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট ও আবগারি আইন, বাজেট বা করহার পরিবর্তন-সংক্রান্ত কোনো আগাম তথ্য; (আ) মুদ্রার বিনিময় ও সুদের হার পরিবর্তনজনিত কোনো আগাম তথ্য; (ই) ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা ও তদারকি-সংক্রান্ত কোনো আগাম তথ্য; (চ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে এমন তথ্য; (ছ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বা বিচারাধীন মামলার সুষ্ঠু বিচারকার্য ব্যাহত হতে পারে এমন তথ্য;
(জ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন তথ্য;
(ঝ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে কোনো ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে এমন তথ্য;
(ঞ) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তার জন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক গোপনে প্রদত্ত কোনো তথ্য; (ট) আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয় এবং যা প্রকাশে আদালত বা ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অথবা যার প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল এরূপ তথ্য; (ঠ) তদন্তাধীন কোনো বিষয় যার প্রকাশ তদন্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এরূপ তথ্য; (ড) কোনো অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করতে পারে এরূপ তথ্য; (ণ) কৌশলগত ও বাণিজ্যিক কারণে গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় এমন কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ কোনো তথ্য; (ত) কোনো ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে বা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ক্রয় বা কার্যক্রম-সংক্রান্ত কোনো তথ্য; (থ) জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকারহানির কারণ হতে পারে এমন তথ্য; (দ) আইন দ্বারা সংরক্ষিত কোনো ব্যক্তির গোপনীয় তথ্য; (ধ) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বর সম্পর্কিত আগাম তথ্য; (ন) মন্ত্রিপরিষদ বা ক্ষেত্রমত, মন্ত্রিপরিষদের মর্যাদাসম্পন্ন কোনো পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপনীয় সার-সংক্ষেপসহ অনুষঙ্গিক দলিলাদি এবং উক্তরূপ বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কোনো তথ্য; (প) কমিটি বৈঠকে উত্থাপনীয় কাগজপত্র; তবে শর্ত থাকে যে, মন্ত্রিপরিষদ বা ক্ষেত্রমত, মন্ত্রিপরিষদের মর্যদাসম্পন্ন কোনো পরিষদ ও কমিটির বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর অনুরূপ সিদ্ধান্তের কারণ এবং যে সব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে তা প্রকাশ করা যাবে। আরও শর্ত থাকে যে, নীতিমালার অধীন তথ্য প্রদান স্থগিত রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তথ্য কমিশনের অনুমতি নিতে হবে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ
যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাহিদা মাফিক জনগণকে তথ্য দেয়ার জন্য সংসদে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। সংসদের সিনিয়র সচিব এ কর্মকর্তা নিয়োগ দেবেন। তার কাছে তথ্য না পেলে আপিল করা যাবে। আপিল কর্তৃপক্ষ হবেন সংসদের সিনিয়র সচিব।
কোনো ব্যক্তি এ নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য লাভে ব্যর্থ হলে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত মূল্য ধার্য বা গ্রহণ করলে ওই সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার, বা ক্ষেত্রমত, সিদ্ধান্ত লাভের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সাবেক তথ্য কমিশনার
অধ্যাপক সাদেকা হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ নীতিমালা আরও আগে করা উচিত ছিল। শুধু নীতিমালা নয়, সংসদের যাবতীয় বিষয় যেমন সাংবিধানিক আলোচনা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, কোন খাতে কত ব্যয়- এসব তথ্য শুধু উন্মুক্ত করলেই হবে না তৃণমূল পর্যায়ে তা পৌঁছাতে হবে। তাহলেই মানুষ উপকৃত হবে, দুর্নীতি কমে যাবে। তবে নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে এটি নিয়ে ডিবেট (যুক্তিতর্ক) করতে হবে, মতামত নিতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করা উচিত।
যা থাকছে তথ্য অবমুক্তকরণ নীতিমালায়
এইচএস/এমএআর/জেআইএম