ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

আত্মতুষ্টিতে মন্ত্রণালয়, আসছে নতুন উদ্যোগ

মুরাদ হুসাইন | প্রকাশিত: ০৯:০৭ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগের ফলে চলতি বছর পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ফাঁসমুক্ত প্রশ্নে পরীক্ষা আয়োজন করতে পারায় সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলছেন শিক্ষামন্ত্রীসহ তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াই উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের দশটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, এসএসসিসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের যে মহামারি শুরু হয়েছিল তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সব মহল। কিন্তু গত ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সাধারণ আট বোর্ডের দশটি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এদিন সাধারণ বোর্ডের অধীনে কৃষিশিক্ষা (তত্ত্বীয়) প্রথম পত্র এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) প্রথম পত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ (বুধবার) মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে কোনো পরীক্ষা ছিল না।

গত সোমবার সাধারণ আট বোর্ডে পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয় পত্র, পৌরনীতি দ্বিতীয় পত্র, জীববিজ্ঞান (তত্ত্বীয় দ্বিতীয় পত্র, ব্যবসায় উদ্যোগ দ্বিতীয় পত্র, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা দ্বিতীয় পত্র) এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে বাংলা সার্টলিপি (তত্ত্বীয় দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা), মাদরাসা বোর্ডের অধীন হাদিস ও উসুলুল হাদিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

এবার পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক কেন্দ্রে প্রবেশের বিধান রাখা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে লটারির মাধ্যমে প্রশ্নের সেট নির্ধারণ, সব সেট প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে ২৫ মিনিট আগে প্যাকেট খোলাসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সবার সার্বিক প্রচেষ্টায় প্রশ্ন ফাঁসের মতো কোনো অঘটন এখন পর্যন্ত ঘটেনি। পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও সারাদেশে প্রশ্ন ফাঁসমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগ
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগে দুই সেট প্রশ্নে পরীক্ষা হলেও এবার একাধিক সেট ছাপানো হয়েছে। বিষয় ভিত্তিক প্রশ্নের ডাবল প্যাকেট করা হয়েছে। প্রথম প্যাকেটের কভারে নিরাপত্তা কসটেপ লাগানো হচ্ছে। আর ভেতরের প্যাকেটে বিশেষভাবে আটকানো থাকছে। কেউ প্যাকেট খুললে দ্বিতীয়বার আর তা লাগাতে পারবে না।

প্যাকেট খোলা ব্যক্তিকে শনাক্তেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সব সেট প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ হচ্ছে পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কেন্দ্রীয়ভাবে লটারির মাধ্যমে। এসএমএসের মাধ্যমে সেই তথ্য জানানো হচ্ছে কেন্দ্রের সচিবকে। তারপর সিকিউরিটি টেপ ও সিলগালা ভেঙে খোলা হচ্ছে প্রশ্নের প্যাকেট।

অন্যদিকে ট্রেজারি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্ন নিতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য সবার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে আগের মতোই। পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা বাদে অন্যদের ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হয়েছে।

Question-not-out-1

এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার হলে বসতে হচ্ছে। কেউ দেরি করলে পরীক্ষার্থীর নাম, রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর নথিভুক্ত করে রাখা হচ্ছে। প্রতিদিন এ তালিকা পরীক্ষা শেষে তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডে পাঠানো হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী একাধিক পরীক্ষায় দেরি করে আসলে তার কারণ খতিয়ে দেখারও নির্দেশনা রয়েছে।

এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষা শুরুর ১৫ দিন আগে থেকে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি এবং সরেজমিন বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রকে ধরতে পুলিশ, সিআইডি ও র্যাব কর্মকর্তারা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ হয়। নির্দিষ্ট কিছু মোবাইল নম্বরে এসব টাকা পাঠানো হয়। সন্দেহজনকভাবে অবৈধ লেনদেন করলে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী বা তার স্বজন ও টাকা গ্রহণকারীকে সহজেই চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নজরদারির মধ্যে নেয়া হয়েছে। বিজি প্রেস থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবখানেই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিশেষ ১৭টি টিম গঠন করা হয়েছে। জাতীয় ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক (৯৯৯) সার্বক্ষণিকভাবে এ ধরনের অভিযোগ তদারকি করছে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ায় নিজেদের সফল মনে করছি না। এটি স্থায়ীভাবে রোধ করতে হবে। এ লক্ষ্য নিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও সতর্কতা অবলম্বনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

শিক্ষা সচিব বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য প্রশ্ন ফাঁসমুক্ত পরীক্ষার আয়োজন। এ কারণে যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব আমরা সব পদক্ষেপই গ্রহণ করেছি। ফলে কিছুটা সফলতাও পাচ্ছি।

‘আগামীতে প্রশ্নপত্র আর প্রিন্ট করা নাও হতে পারে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আগামীতে কেন্দ্রে প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রশ্ন উপস্থাপন করা হতে পারে। সেটি দেখে পরীক্ষার্থীরা উত্তর লিখবে।’

সোহরাব হোসাইন বলেন, আমাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। সব বিষয় মাথায় রেখে পাবলিক পরীক্ষাগুলো আধুনিকায়নে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই নতুন নিয়ম চাপিয়ে দেয়া হবে না। পর্যালোচনা করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।

রাজধানীর বিজ্ঞান কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী তানিয়া ইসলাম জাগো নিউজকে বলে, পরীক্ষা অনেক ভালো হচ্ছে। এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী) প্রশ্ন একটু কঠিন হলেও খারাপ হয়নি। সব মিলিয়ে ১০টা পরীক্ষাই সুন্দরভাবেই দিয়েছি।

সে আরও বলে, ‘লেখাপড়া করেই সব সময় পরীক্ষায় অংশ নেই। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে কখনও ছুটিনি। প্রশ্ন ফাঁসের গুজব শুনেছি কিন্তু কখনও কান দেইনি। দিন-রাত পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিচ্ছি।

‘পরীক্ষার আগেই কেউ যদি প্রশ্ন পেয়ে যায় এবং ওই প্রশ্নে যদি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তো মন খারাপ হবেই। পরীক্ষার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে যায়। তাই সব পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁসমুক্ত রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি’- যোগ করে এ পরীক্ষার্থী।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম। কথা হয় তার বাবা আহসান ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পরীক্ষা শুরুর আগে থেকে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে অনেক উৎকণ্ঠায় ছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ঘটনা না ঘটায় কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছি।

তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের মন ভেঙে যায়। অনেক সময় সে পরীক্ষা সরকার বাতিলও করে। এসব চিন্তায় কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পরীক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়। তাই প্রশ্ন ফাঁসকারীদের শক্ত হাতে দমনের দাবি জানাই।

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, সবার সহযোগিতায় কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি আগামী পরীক্ষাগুলোতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে, প্রয়োজনে আরও নতুন নুতন পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে।

এমএইচএম/এমএআর/আরএস/পিআর

আরও পড়ুন