এক কোটি ভোটারের পরিচয়পত্র পাওয়া অনিশ্চিত
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় ১ কোটি নতুন ভোটারকে অস্থায়ীভাবে লেমিনেটিং করা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিতরণের কথা থাকলেও তা আটকে গেছে। উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র স্মার্টকার্ড পেতে দেরি হওয়ায় এই কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি) কিন্তু চুক্তি করা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আর অবহেলার কারণে তাও ভেস্তে যাচ্ছে।
ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে চুক্তি অনুযায়ী স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র না পেয়ে গত বছরের ৮ নভেম্বর স্মার্ট টেকনোলজিসকে (বিডি) সাধারণ লেমিনেটিং কার্ড ছাপানোর কাজ দেয় ইসি। সেই সময় সর্বনিম্ন দুইজন দরদাতার কাউকে কাজ না দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। এজন্য স্মার্ট টেকনোলজিসের সঙ্গে ৮ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ৪০০ টাকার চুক্তি হয়। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ৯৩ লাখ লেমিনেটেড কার্ড উৎপাদনের জন্য চুক্তি করে ইসি। ৯৩ লাখ কার্ডের মধ্যে ৭০ লাখ মুদ্রণ শেষ করে কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়েও দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি কমিশন সেগুলো দেশের ৭ জেলার সব উপজেলায় বিতরণের জন্য পাঠায়, যা কমিশনের ১৭তম সভার কার্যপত্রে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এসব কার্ড অত্যন্ত নিম্নমানের।
মাঠ পর্যায় থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ইসি। আইডিয়া প্রকল্পে উপ প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাইকে আহ্বায়ক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আইডিয়া প্রকল্পের সংযুক্ত কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুল্লা নাসের, এনআইডির সহকারী পরিচালক এ এস এম ইকবাল হাসান ও আইডিয়া প্রকল্পের জুনিয়র কমিউনিকেশন্স কনসালটেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ আশিকুর রহমান।
কমিটি ওই পরিচয়পত্রে আট ধরনের ক্রটি খুঁজে পাই। এর মধ্যে কার্ড মুদ্রণে রিফিল কালি ব্যবহার, কার্ড সঠিকভাবে কাটিং না করায় অসংখ্যা কার্ডে ভোটারের তথ্য কাটা পড়া, লেমিনেটিংয়ের সময় মেশিনে সঠিকভাবে হিট না দেয়ায় মুদ্রিত কার্ডটি খুলে যাওয়া, নেমিনেশন না করেই সংরক্ষিত বাক্সে পেপার কার্ড রাখা, পোড়া কার্ড সরবরাহ করাসহ নানান অনিয়ম পায় কমিটি।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটির কাজ পাওয়ার পর অনেক কম্পিউটারের দোকানে সাব-কন্ট্রাক্টে তা ভাগ করে দেয়া হয়। এমনকি রাজধানীর কয়েকটি বস্তিতে এই কার্ড ছেঁড়া-ফাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অযত্ন ও অবহেলায় কার্ড মুদ্রণ ও লেমিনেটিং এর কাজ করেছে। কাজের গুণগত মানের দিক বিবেচনা না করে দায়সারাভাবে কাজ শেষের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এ ধরনের নিম্নমানের কার্ড গ্রহণ করে মাঠ পর্যায়ে বিতরণের জন্য পাঠালে কর্মকর্তারা বিড়ম্বনার শিকার হবেন। পাশাপাশি ভোটাররা এ ধরনের কার্ড গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। এ নিয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, যা কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদ মঙ্গলবার জাগো নিউজকে বলেন, কাজে অনিয়ম তদন্তে প্রথম কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি। স্মার্ট টেকনোলজিসের কাজ নিম্নমানের হয়েছে বলে প্রাথমিকভাব গঠিত তদন্ত কমিটি জানিয়েছে। এজন্য এসব কার্ড বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
জানা যায়, স্মার্টকার্ড বিতরণে ধীর গতির কারণে কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেয়ার ২০১৭ সালের পরে যেসব ভোটার বা তরুণ প্রজন্মের ভোটার রয়েছে এমন ১ কোটি ১৮ লাখ ভোটারকে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার পাশাপাশি পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে তাদের স্মার্টকার্ডও দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময়ের মধ্যে নতুন ভোটাররা যাতে বিভিন্ন কাজে এই লেমিনেটিং কার্ড ব্যবহার করতে পারেন সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছি।
লেমিনেটিং কার্ডে বদলে স্মার্টকার্ড দেয়ার জন্য ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ওবের্থার টেকনোলজিসের (ওটি) সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইসি। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ৮১৬ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি স্মার্টকার্ড পৌঁছে দিবে। কিন্তু পারেনি তারা।
এজন্য চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উপজেলা পর্যায়ে মাত্র এক কোটি ৯৮ লাখ (১২ দশমিক ২০ শতাংশ) কার্ড পৌঁছাতে পেরেছে। এখনও ব্ল্যাঙ্ক (ফাঁকা) কার্ড আসেনি দুই কোটি ৩৬ লাখ চার হাজার। এ পর্যন্ত ৫১ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিল নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য ইসি চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। তাই বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র ছাপানো হচ্ছে বলে জানায় ইসি। তবে সেই কার্ড এখনও কেউ দেখেনি। আর স্মার্টকার্ডের এ অনিশ্চয়তা ১ কোটির বেশি ভোটারকে আটকে না রেখে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে সবাইকে লেমিনেটিং করা কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইসি।
এইচএস/জেএইচ/আরআইপি