বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে
দেশে প্রতি বছর রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে। অতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ হয়েছে ৫৬ লাখ এক হাজার টন। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় সাত লাখ ৫১ হাজার টন বেশি।
সারের চাহিদা নির্ধারণের সঙ্গে তা সংগ্রহ পরিকল্পনাও চূড়ান্ত হয়েছে। সম্প্রতি সার বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী ও কমিটির প্রধান মতিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা) মো. আবুবকর সিদ্দিক জাগো নিউজকে সারের চাহিদা নির্ধারণ ও সংগ্রহ পরিকল্পনার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
সারের চাহিদা নির্ধারণের প্রক্রিয়া তুলে ধরে যুগ্ম সচিব বলেন, ‘প্রতি বছর সারের চাহিদা নির্ধারণের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর মাঠপর্যায়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জরিপের ভিত্তিতে আগামী অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এ প্রস্তাব পর্যালোচনাসহ সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও উপকরণ) সভাপতিত্বে গত ২৮ জানুয়ারি একটি সভা হয়। সারের চাহিদা ও সংগ্রহ পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটির ওই সভায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।
কমিটি বিগত বছরগুলোতে সারের ব্যবহার, সারের মূল্য, শস্য আবাদের ধরন, নিবিড়তা, মাটির স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করে আগামী অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ করেছে।
পরে জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভায় সেই প্রস্তাব অনুমোদন পায়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে দেশে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন ইউরিয়া, সাত লাখ টন টিএসপি, নয় লাখ টন ডিএপি, আট লাখ ৫০ হাজার টন এমওপি, ৩০ হাজার টন এমএপি, ৫০ হাজার টন এনকেপিএস, তিন লাখ টন জিপসাম, এক লাখ টন জিংক সালফেট, ১০ হাজার টন এমোনিয়াম সালফেট, ৮০ হাজার টন ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও ৪০ হাজার টন বোরন সার প্রয়োজন হবে বলেও জানান যুগ্ম সচিব।
২৫ লাখ ৫০ হাজার টন ইউরিয়া সারের চাহিদার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ১০ লাখ টন উৎপাদন করবে। বিসিআইসি অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি (সরকার টু সরকার) ও দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টন সার সংগ্রহ করবে।
সাত লাখ টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সারের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তিন লাখ ৭৫ হাজার টন, বিসিআইসি ৭৫ হাজার টন সংগ্রহ করবে। বেসরকারিভাবে আমদানিকারকদের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন টিএসপি সংগ্রহেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আগামী অর্থবছর দেশে নয় লাখ টন ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সারের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে বিএডিসি সরকার টু সরকার চুক্তির মাধ্যমে চার লাখ টন এবং বিসিআইসি এক লাখ টন আমদানি করবে। বেসরকারিভাবে ডিএপি সার আমদানি করা হবে চার লাখ টন।
এমওপির (মিউরেট অব পটাশ) চাহিদা নির্ধারণ হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার টন। এক্ষেত্রে বিএডিসি সরকারি পর্যায়ে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টন আমদানি করবে।
বেসরকারিভাবে আমদানিকারকদের মাধ্যমে বাকি সার সংগ্রহ করা হবে। ভর্তুকি কর্মসূচির আওতায় বেসরকারিভাবে আমদানিকারকরা সার আমদানি করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন আবুবকর সিদ্দিক।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত দুই বছরসহ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সারের ব্যবহারের ধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কৃষিসহ অকৃষি খাতে ইউরিয়ার ব্যবহার সংযোজন হওয়ায় এ সারের ব্যবহার কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ডিএপি সারের ব্যবহারও ক্রমাগত বাড়ছে। এজন্য ইউরিয়া ও ডিএপি সারের চাহিদা ৫০ হাজার টন বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছর ৪৮ লাখ টন রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ হয়েছিল। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৫ লাখ টন, টিএসপি সাত লাখ ৫০ হাজার টন, ডিএপি সাত লাখ ৫০ হাজার টন ও এমওপি সার আট লাখ টন।
বর্তমানে কৃষকপর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা। এছাড়া টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা ও ডিএপি সার ২৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি সারে যথাক্রমে কমপক্ষে ২৪, ১৮, ১৮ ও ২৫ টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবহৃত সারের একটি অংশ অপচয় হচ্ছে, যা নানা প্রকার ক্ষতিকারক উপাদানে পরিণত হয়ে পরবর্তীতে প্লাবন বা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাভূমি এবং বনভূমির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। রাসায়নিক সারের মাধ্যমে ফলানো ফসলে কিছু নেতিবাচক গুণ বহন করে, যা খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এমন মত দিয়েছেন কৃষি সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে খাদ্যশস্য ফলাতে সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। আমাদের দেশে সেভাবে গবেষণা না হলেও রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহারের খারাপ দিক রয়েছে। এতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীসহ সার্বিকভাবে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ম. এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘সার জমিতে দেয়া হয়, এর একটা সরাসরি প্রতিক্রিয়া আছে। এতে মাটির মধ্যে যেসব জৈবপ্রাণী রয়েছে, অর্থাৎ কেঁচো বা এ ধরনের প্রাণী গাছের অক্সিজেন দেয়াসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল দেয়; সেগুলোকে মেরে ফেলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টির পানি বা অন্যান্যভাবে সার ধুয়ে নিচু স্থানে চলে যায়, ফলে এর ইফেক্টটা একটু কমে যায়। কিন্তু তখন মাছের পোনা বা ডিমের ওপর এর ভয়ানক প্রতিক্রিয়া পড়ে। এ কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ প্রচুর পরিমাণে কমে গেছে, এটা তো আমরা প্রত্যক্ষ করছি।’
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে গত বছরের ২৯ মার্চ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটের হাওর অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। বন্যায় হাওরের বোরো ধান নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় বিপুল পরিমাণ মাছ, হাঁস ও পাখি। সরকারি হিসাবে এক হাজার ৭৬ টন মাছ মারা যায়, হাঁস মারা যায় তিন হাজার ৮৪৪টি।
অনেকেই মনে করেন, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে, এর সঙ্গে ধান পঁচে টক্সিক (বিষ) তৈরি হয়, এতে মাছ ও হাঁস মারা যায়।
যে কারণে বাড়ছে সারের ব্যবহার
খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা কারণে রাসায়নিক সারের চাহিদা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুবকর বলেন, ‘এখন জমিতে একটির স্থলে একাধিক ফসল হচ্ছে। এজন্য জমির উর্বরতা ধরে রাখতে সার ব্যবহার বেড়েছে।’
এছাড়া সারের অকৃষি ব্যবহারও বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্প কারখানার নানা কাজে এখন রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়। গবাদিপশু মোটাতাজা করতে সার ব্যবহার হচ্ছে। আগে মানুষ শাক-সবজি ও ফল উৎপাদনে সেভাবে সার ব্যবহার না করলেও এখন এসব ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে।’
গত ৫ বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে ৩৯ লাখ ছয় হাজার টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪২ লাখ ৬৬ হাজার টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৫ লাখ ৯৮ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৪ লাখ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টন রাসায়নিক সারের ব্যবহার হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে সারের চাহিদা ও ব্যবহার পরিস্থিতি
চলতি অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টন রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুবকর সিদ্দিক বলেন, ‘গত ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি মিলে ৪০ লাখ টনের বেশি সার ব্যবহার হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত ব্যবহার ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।’
বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা জানান, সদ্যসমাপ্ত পিকসিজনে সার কারখানায় গ্যাস পাওয়ার অনিশ্চয়তা এবং বন্দরে জাহাজজটের কারণে সার আমদানিতে জটিলতা সত্ত্বেও কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় সার সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরও জানান, কারখানায় গ্যাস সংযোগ থাকলে সার সরবরাহে তেমন বেগ পেতে হয় না। কারণ সার আমদানিতে সময় যেমন বেশি লাগে তেমনি বন্দরে সার খালাসে অবকাঠামোগত অসুবিধাও রয়েছে। বন্দরে অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে জাহাজের ভাড়াও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাই আগামী অর্থবছরে সার কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
আরএমএম/এমএআর/আরআইপি