খেলাপি ঋণ আদায়ে তৃতীয় পক্ষকে কার্যকরের উদ্যোগ
ব্যাংকিং খাতে দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এক বছরের ব্যবধানে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা বেড়ে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বাড়ার এ ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ২০০১ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বেসরকারি এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। পরবর্তীতে উদ্যোগটি বেশ ফলপ্রসূও হয়। কিন্তু ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় বেশ কিছুদিন ধরে এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাই আবার উদ্যোগটি কার্যকর করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস কর্পোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেড দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে সেনালী ব্যাংকসহ আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে এজেন্ট নিয়োগে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়। সে সময় পিডিএসসি লিমিটেডের পাশাপাশি আরও তিন প্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রম শুরু করে।
জানা গেছে, মামলার জটে আবদ্ধ ঋণ আদায় কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে তেমন সফলতা না আসলেও তিন বছরের মধ্যে বিষয়টি ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকসমূহের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহ থেকে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত অনাদায়ী মন্দ ও কুঋণ যা অর্থঋণ আদালতের মামলায় ঋণ আদায় কার্যক্রম উচ্চ আদালত কর্তৃক বন্ধ থাকা খেলাপি ঋণ হিসাবসমূহ এজেন্টগুলোর নিকট হস্তান্তর করা হয়। এসব ঋণের বেশকিছু ঋণ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়।
একপর্যায়ে ভুয়া বন্ধকী জমি, মালিকানা সম্পত্তি বিরোধ এমনকী অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণসমূহের দায়িত্ব এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া হয়। কিন্তু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকসমূহের হাতেই রাখা হয়। তাই চুক্তিবদ্ধ এজেন্ট ইচ্ছা করলে মামলায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। অপরদিকে ব্যাংক কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবীগণ ঋণখেলাপির সঙ্গে যোগসাজশে মামলা দীর্ঘায়িত বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করেন। ফলে ঋণ আদায় স্বাভাবিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এসব অপকৌশলের সঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্যানেল আইনজীবী ঋণখেলাপিকে সহযোগিতা করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এসব অসহযোগিতার কারণে গত চার-পাঁচ বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপ-সচিব মো. সাজ্জাদুল হাসান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানায়।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিষয়টি তারাও অবগত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিও তারা হাতে পেয়েছেন। এখন বিষয়টি কার্যকর করতে তারা সবকিছু খতিয়ে দেখছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংকিং খাত। যা দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ। যেভাবেই হোক এসব ঋণ আদায় করতে হবে। ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের এজেন্ট রয়েছে। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি এজেন্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও সম্পৃক্ততা বেশ ফলপ্রসূ উদ্যোগ।’
খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসকারি এজেন্টের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঋণখেলাপিরা সাধারণত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তারা কাউকে পরোয়া করেন না। খেলাপি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক তাদের নামে যে মামলা দায়ের করে, আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে তারা মামলাকে দীর্ঘস্থায়ী ও কালক্ষেপণ করতে সক্ষম হন। ফলে খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব হয় না। তাই ব্যাংকগুলো মারাত্মক আর্থিক সংকটে পতিত হয়। এতে নতুন নতুন বিনিয়োগ প্রক্রিয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসমূহের হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহ আইনি সীমাবদ্ধতা ও নিজেদের দক্ষ লোকবলের স্বল্পতার কারণে সব ঋণখেলাপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি আত্মপরিচয় গোপন করে গাঢাকা দেয়। তাই খেলাপি ঋণের একটা অংশ আদায় অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতি অবস্থার প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ ধরনের খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য উদ্যোগ নিতে হয়। একজন চাকরিজীবী ব্যাংকারের পক্ষে এ ধরনের ঝুঁকি নেয়া প্রায় অসম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে সরকারি-বেসরকারি নয়টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৭ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এমএআর/আরএস/আরআইপি