‘ঝুঁকিপূর্ণ’ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হচ্ছে ভাসানচরে
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাদের আশ্রয় হয়েছে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত এলাকাসহ কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা আসছে বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও ভূমিধসের মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে আছেন। তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ সরকারও ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে এক লাখ তিন হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মিত হচ্ছে নোয়াখালীর ভাসানচরে। আশ্রয়ণ ‘৩’ আবাসন প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ীভাবে বসবাসের জায়গা পেতে যাচ্ছেন তারা। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্পেরও অনুমোদন দিয়েছে। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী।
১০ লাখের মধ্যে কারা যাবেন ভাসানচরের গুচ্ছগ্রামে এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষ থেকে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও। তবে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘আসন্ন বর্ষাকালে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢল ও পাহাড় ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থানরত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের রক্ষায় প্রস্তুতি গ্রহণ’ সংক্রান্ত এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার কার্যপত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কার্যপত্র সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সভায় দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল জানান, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএনএইচসিআর ও আইওএম’র অর্থায়নে এডিপিসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় সম্ভাব্য ভূমিধস ও বন্যার ঝুঁকি থাকা এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সমীক্ষা অনুযায়ী দুই লাখ তিন হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা সহজে স্থান পরিবর্তন করতে চান না। তাই ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের বিষয়ে ইউএনএইচসিআর, আইওএম ও ক্যাম্প ইনচার্জদের সহায়তায় উদ্ধুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরের সময় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভাসানচরে এক লাখ তিন হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মিত হচ্ছে। দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী। প্রকল্প শুরুর সময়েই ১৫০ কোটি টাকার অর্থছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। আরও এক হাজার ৩০০ কোটি টাকার দ্রুত ছাড় চাওয়া হয়েছে। চলতি অর্থ বছরেই এ প্রকল্পে আরও ৫০০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভায় আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরত রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদ স্থানে কিংবা ভাসানচরে যেতে উৎসাহী হয় সেজন্য অতিবৃষ্টিজনিত ভূমিধস কিংবা পাহাড়ি ঢলে জানমালের যে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে এতদসংক্রান্ত ‘প্রামাণ্যচিত্র’ এবং ‘উদ্বুদ্ধকরণ ব্রিফ’ প্রস্তুতপূর্বক প্রদর্শন এবং বিতরণ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপশি কর্মরত এনজিওসমূহকে এ কাজে নিয়োজিত করতে হবে।
ভাসানচরের ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩’ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করতে হবে। ইউএনআরসি, আইওএম, ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপিসহ আইএসসিজি-কে ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
রোহিঙ্গারা যাতে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয় সেজন্য সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি প্রচার-প্রচারণায় নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ সমন্বয়ের জন্য কক্সবাজারপ্রান্তে তালিকা প্রস্তুত, মোটিভেশন এবং পরিবহনের জন্য একটি কমিটি এবং নোয়াখালীতে একটি পৃথক কমিটি গঠন করতে হবে। কক্সবাজার ও নোয়াখালীর কমিটির কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিতে হবে।
ভাসানচরে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল, অফিস সরঞ্জামাদি, যানবাহন ও অন্যান্য সুবিধাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাসানচরে মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওসমূহকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের নবনির্মিত ‘ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প’- এ স্থানান্তর শুরুর আগে কতুপালং ও নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের অনুমোদিত জনবল কাঠামোর অনুরূপ অতিরিক্ত জনবল ও অফিস স্থাপন করতে হবে।
এ বিষয়ে নজিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে। আশ্রয়শিবির এলাকায় সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা কার্যক্রম অধিকতর জোরদার করতে হবে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা চার লাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। গত বছর ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর আরও সোয়া ছয় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আসছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ‘শরণার্থী সমস্যা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর