মোটরসাইকেলে নিজ উদ্যোগে যাত্রী পরিবহন
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্যস্ত সিগন্যাল। বাসের জন্য সাধারণ যাত্রীদের অপেক্ষা। বাস এসে স্টপেজে দাঁড়ানোমাত্রই হুমড়ি খেয়ে যাত্রীদের ওঠার চেষ্টা। কিন্তু ব্যর্থ হন অনেকে। কারণ যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম, সিটও অপ্রতুল।
গাদাগাদি করে অনেকে উঠতে পারলেও সে সৌভাগ্য সবার হয় না। বাধ্য হয়ে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা। এভাবে ভিড়ও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এমন সময় মোটরসাইকেল নিয়ে এক আরোহী সেখানে হাজির। বললেন, শ্যামলীর দিকে কেউ যাবেন, ৮০ টাকা ভাড়া পড়বে। তাৎক্ষণিক অপেক্ষমাণ এক যাত্রী রাজি হয়ে ওঠে বসলেন মোটরসাইকেলে। গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চললো মোটরসাইকেলটি।
কারওয়ান বাজারের বাস স্টপেজে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় থাকাকালীন ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে এমন বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহনের দেখা মিললো তিন মোটরসাইকেল আরোহীর।
পাবলিক বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীর সংখ্যা যখন বাড়ছে তখনই আরেক মোটরসাইকেল আরোহী এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, উত্তরার দিকে কেউ যাবেন কি-না? তখনই আলাপ হয় আগন্তুক সেই মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে।
তিনি একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। মতিঝিলে অফিস হলেও উত্তরার ভাড়া বাসা থেকে প্রতিদিন নিজ মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। নাম আব্দুল হাই। বলেন, ‘যেহেতু আমার অফিস মতিঝিলে, তাই প্রতিদিন সকালে উত্তরা থেকে আসার সময় মোটরসাইকেলে যাত্রী নিয়ে আসি। অফিস টাইম হওয়ায় বাসের জন্য অনেকেই অপেক্ষা করেন। মোটরসাইকেল স্লো করে ‘মতিঝিলের দিকে কেউ যাবেন নাকি’- এমন ডাক দিলে অনেকেই রাজি হন। আসা-যাওয়ার সময় এভাবে যাত্রী আনা-নেয়া করি। দিনে তিনশ থেকে চারশ টাকা পর্যন্ত ইনকাম হয়। তেল খরচ ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন হয়। এ কারণে প্রায়দিনই যাত্রী বহন করি।’
তিনি বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু উবার, পাঠাওয়ের মতো স্মার্টফোননির্ভর রাইড শেয়ারিং সার্ভিস দেয় কিন্তু আমি সেখানে নিবন্ধন করিনি। তাদের অ্যাপস চালানো, তাদের কমিশন দেয়া আমার কাছে ঝামেলার মনে হয়। তাই নিজেই চালাই, যাত্রী পেলে পেলাম; না পেলে নাই।’
এক জরিপ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) জানায়, নব্বয়ের দশকে রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। ২০১৫ সালে এসে ঠেঁকে মাত্র তিন হাজারে।
অন্যদিকে ২০১০ সালে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৪৯৫; ২০১৬ সালে যা এসে দাঁড়ায় চার লাখ ৩৬ হাজার ৫৫টি। দিন দিন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে গণপরিবহনের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমছে। যে কারণে গণপরিবহনের জন্য সাধারণ মানুষকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা শেষে অনেকটা যুদ্ধ করে উঠতে হয়।
আরও একটি জরিপ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পবা বলছে, রাজধানীতে দিনে অন্তত ছয় লাখ মানুষ নানা প্রয়োজনে ঢাকা শহরে আসছেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দিনে অন্তত ২১ লাখ পরিবহন ট্রিপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যানজটের কারণে ২১ লাখের তিনভাগের একভাগ ট্রিপ হয় না। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতি তিন হাজার যাত্রী যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র একটি। এছাড়া অটোরিকশাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অচল। গণপরিবহন সঙ্কটের বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় প্রতিদিন নামছে ৩৭টি ব্যক্তিগত গাড়ি।
শুধু কারওয়ান বাজারে নয় রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মহাখালী ও গুলশান ঘুরেও ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে নিজ উদ্যোগে যাত্রী পরিবহনের চিত্র দেখা মেলে।
রাজধানীর শাহবাগে এমন এক মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে ভাড়ায় বনিবনা না হওয়ায় মোটরসাইকেলে উঠলেন না এক মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী। আলাপ হয় তার সঙ্গে। নাম খন্দকার আক্তার। বলেন, ওই মোটরসাইকেল আরোহী কল্যাণপুরের দিকে যাচ্ছেন। আমি আদাবর যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ২৫০ টাকা চান। আমি ১০০ টাকা দিতে চেয়েছি, তিনি রাজি হননি।
‘অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু উঠতে পারিনি। সিএনজিও অনেক টাকা ভাড়া চায়। যে কারণে ওই মোটরসাইকেল আরোহী যখন এসে বললো, আমি রাজি হই। পাঠাও-উবারসহ অন্য কোনো অ্যাপসে আমার নিবন্ধন নেই। যে কারণে মাঝে মধ্যে এভাবে যাতায়াত করি।’
গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষায় থাকা তোফাজ্জল হোসেন একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, এভাবে অপরিচিত কারও সঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়া উচিত নয়। যে কোনো সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ ওই মোটরসাইকেল আরোহী সম্পর্কে আপনি-আমি কেউ কিছু জানি না। তবে বাধ্য হয়ে অনেকে এভাবে যাতায়াত করেন।
এ বিষয়ে কথা হয় যাত্রী অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহমুদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এভাবে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে আমরাও শুনেছি। যাত্রীদের জন্য অনেক সময় পরিবহনের সঙ্কট থাকে, অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে অনেক সময় যাত্রীরা বসে উঠতে পারেন না। এদিকে সিএনজি ভাড়াও বেশি, আবার উবার-পাঠাওয়ের অ্যাপসে অনেকেরই রেজিস্ট্রেশন করা নাই। যে কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমনভাবে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন অবশ্যই ভালো একটি উদ্যোগ। তবে এ বিষয়ে যাত্রীদের একটু সচেতন হতে হবে।
‘সব মানুষ তো আর ভালো নয়। যে কারণে যাত্রীরা অনেক সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে পারেন। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মোটরসাইকেল আরোহীদেরও একটা নীতিমালা অর্থাৎ যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে একটি উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে’ যোগ করেন তিনি।
এএস/এমএআর/জেআইএম