শেয়ারবাজারে জুজুর ভয়
দেশের শেয়ারবাজারে ঢুকেছে জুজুর ভয়। অজানা আশঙ্কা আর আতঙ্কে বাজারে চলছে টানা দরপতন। কমে গেছে তারল্য সরবরাহও। ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে দেখা দেয়া জুজুর ভয়ে শেয়ারবাজারে নেমেছে এক প্রকার ধস।
বাজার সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত কমানোর কারণে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারেও দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। তবে মুদ্রা বাজারে তারল্য সংকট নেই বলে দাবি করেছেন গভর্নর ফজলে কবির।
তিনি বলেন, এডিআর নিয়ে ব্যাংক খাতে প্যানিক শব্দটি চলে এসেছে। এটির কোনো কারণ দেখছি না। এডিআর ৮৩.৫ শতাংশ হওয়ার কারণে ব্যাংকাররা বলছে ডিপোজিট অনেক বেশি ফল (পতন) করছে। ডিপোজিট অনেক বেশি বাড়াতে হবে রেশিও ঠিক করার জন্য। সেটাও ঠিক নয়। ব্যাংক খাতে অহেতুক প্যানিক দেখা দিয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অপর একটি অংশ বলছে, কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছে। ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা যে কোনো উপায়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে স্বার্থবিরোধী কিছু হলে ব্রোকাররা কঠোর অবস্থানে যাবে। বিষয়টি যেমন ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টরা জানেন, তেমনি বিনিয়োগকারীরাও জানেন। ফলে সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক প্রকার আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এ আতঙ্কের কারণে বাজারে সেল পেশার (বিক্রির চাপ) বেড়ে গেছে। যে কারণে ঘটছে টানা দরপতন।
তবে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশের অভিযোগ, শেয়ারবাজারে যে দরপতন চলছে তা পরিকল্পিত। এর পেছনে ডিএসইর প্রভাবশালী ব্রোকারেজ হাউসের পাশাপাশি ছোটরাও রয়েছে। যাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে কিছু মার্চেন্ট ব্যাংক।
মনির হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা একজোট হয়েছেন। অধিকাংশ হাউস শেয়ার ক্রয়-বিক্রিয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুটির যতদিন মীমাংসা না হচ্ছে ততদিন বাজার পরিস্থিতি ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। হাউসে গেলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাজার আরও পড়বে। গত কয়েকদিন ধরে তো বাজার পড়েই যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে শেয়ার কেনার সাহস দেখায় বলেন।
মো. হাশেম নামের আর এক বিনিয়োগকারী বলেন, ছয়দিন টানা দরপতনে মূলধন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাজার তো বেশ ভালোই ছিল। হঠাৎ এমন দরপতনের কোনো কারণ দেখি না। ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টরা পরিকল্পতিভাবে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। দরপতন ঘটাতে তারা তারল্য সংকট ও কৌশলগত বিনিয়োগকারীর ইস্যুকে সামনে আনছেন। মূলত কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতেই ব্রোকার মালিকরা এটা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী হতে চীনের দুই শেয়ারবাজার সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও সেনজেন কনসোর্টিয়াম এবং ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, ফন্ট ইয়ার বাংলাদেশ ও নাসডাক কনসোর্টিয়াম আগ্রহ দেখিয়েছে।
এদের মধ্যে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও সেনজেন কনসোর্টিয়াম ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। এ জন্য কনসোর্টিয়ামটি ডিএসইর প্রতিটি শেয়ারের দাম দিতে চেয়েছে ২২ টাকা। আর ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, ফন্ট ইয়ার বাংলাদেশ ও নাসডাক কনসোর্টিয়াম ডিএসইর ২৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। এ জন্য প্রতিটি শেয়ারের দাম দিতে চেয়েছে ১৫ টাকা।
দুই কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে ডিএসইর পর্ষদ শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম দিতে চাওয়া সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও সেনজেন কনসোর্টিয়ামকে বেছে নিয়েছে। সেই মোতাবেক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তবে বিএসইসি থেকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী করতে চাপ দেয়া হয়। ফলে ডিএসইর প্রস্তাব বিএসইসি অনুমোদন করবে কি-না তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ডিএসইর প্রভাবশালী এক সদস্য বলেন, আমরা ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন এমনভাবে করেছি যে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করা শেয়ারের টাকা সব ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হবে। কোম্পানিতে (ডিএসই) কোনো টাকা জমা হবে না। ফলে শেয়ারের দাম কম পেলে ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের ক্ষতি হবে। সুতরাং আমরা এমন খতি কিছুতেই মেনে নেবো না।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে যে দরপতন চলছে, এর পেছনে রয়েছে তারল্য সংকট। মুদ্রা বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তারল্য সংকট রয়েছে। আর সার্বিক আর্থিক খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়ায় শেয়ারবাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে শেয়ারবাজারে দরপতনের কিছু নেই। মূলত তারল্য সংকটের কারণেই দরপতন হচ্ছে। সুদের হার সেভাবে না বাড়লেও বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক ও মর্ডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর ই নাহারিন জাগো নিউজকে বলেন, কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে সম্প্রতি দরপতন দেখা দিয়েছে। আমরা সব মেম্বার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে উল্টা-পাল্টা কিছু হলে বা সদস্যদের স্বার্থহানি হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
কৌলগত বিনিয়োগকারী ইস্যু কীভাবে শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৌলগত বিনিয়োগকারী ব্রোকারেজ হাউসের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলেও এর সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ব্রোকারেজ মালিকদের সঙ্গে কমপক্ষে এক লাখ বিনিয়োগকারী সম্পৃক্ত। তাদের সঙ্গে আরও লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং এটি পিরামিড আকার জড়িত। কৌলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে কী হবে সে বিষয়ে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে সবাই শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছে।
টানা পড়লো ২৭০ পয়েন্ট
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা দরপতনের মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজার। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিএসইতে টানা ছয় কার্যদিবস দরপতন হয়েছে। এ ছয় কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স’র পতন হয়েছে ২৭০ পয়েন্ট।
১৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন
টানা দরপতনের পাশাপাশি লেনদেন খরাও দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে ১৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। ওই দিন ডিএসইতে লেনদেন হয় ২৮৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ১১ জুলাই’র এরপর এটিই ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন। শুধু বৃহস্পতিবার নয় শেষ চার কার্যদিবসের একদিনও ডিএসইতে লেনদেন ৪০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি।
উধাও ১৫ হাজার কোটি টাকা
টানা দরপতনের কারণে ডিএসইর বাজার মূলধনের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল চার লাখ ২০ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। যা ২৫ ফেব্রুয়ারির লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৫ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ টানা দরপতনের কারণে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা।
এমএএস/এএইচ/জেআইএম