ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

দূষিত পানির কারখানা পেলেই সিলগালা

প্রকাশিত: ০২:২৭ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পানির অপর নাম জীবন। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির কোনো বিকল্প নেই। শহুরে ব্যস্ত জীবনে বোতলজাত পানি বা জার পানির ওপর অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। এ সুযোগে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় পানি নিয়ে অবৈধ ব্যবসা শুরু করেছেন। অনুমোদনহীন নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিশোধন ছাড়াই বিশুদ্ধ বলে বোতল বা জারে বিষাক্ত পানি সরবরাহের কারণে এখন তা মরণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) প্রকাশিত গবেষণায় ঢাকার ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ পাওয়ার তথ্য আসে। সংস্থাটি জানায়, বোতলজাত ও জারের পানিতে আছে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন ই-কলি (Escherichia coli)। এ ব্যাকটেরিয়া থেকে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠান্ডা। এছাড়া এটি আস্তে আস্তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।

গবেষণায় আরো বলা হয়, ১০০ মিলি জার পানির নমুনায় ১ থেকে ১৬০০ এমপিএনের বেশি ই-কলি পাওয়া গেছে, যেখানে বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী শূন্য ই-কলি থাকা উচিত।

বিএআরসির গবেষণায় সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, সব সময় নিরাপদ পানি যেমন ফুটানো পানি ব্যবহার করতে হবে এবং জার পানি ও বোতলজাত পানি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সারাদেশ বিএসটিআইর লাইসেন্সধারী পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩১৯টি। তবে বর্তমানে ১৯৯টি প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ৮৩টি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইর লাইসেন্স নিয়ে পানি উৎপাদন ও বিপণন করে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান বোতলজাত আর বাকিগুলো জারের পানি বিক্রি করে।

রাজধানীতে পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী অবৈধ প্রতিষ্ঠানে সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এ সংখ্যা সহস্রাধিক। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণুযুক্ত ও মানহীন পানি উৎপাদনকারীদের অর্থদণ্ডের পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।

অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। সম্প্রতি এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জন্য ক্ষতিকর পানি সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতকে নির্দেশনা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

pani

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে নামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি উৎপাদন ও বাজারজাতের অভিযোগে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। বন্ধ (সিলগালা) করে দেয়া হয় একাধিক পানির কারখানা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা নিয়মিত পানি উৎপাদন ও সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করছি। অনুমোদনহীন নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যারা পানি উৎপাদন করছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। গত দুই সপ্তাহে এককভাবে ১০টির বেশি কারখানাকে জরিমানা ও সিলগালা করা হয়।

অধিদফতরের এ সহকারী পরিচালক জানান, রাজধানীর মিরপুর, সেগুনবাগিচা, মালিবাগ এলাকায় যে কয়টি জার পানির কারখানায় অভিযান চালান তার সবকটি নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি সরবারহ করে। তাদের অধিকাংশের অনুমোদন নেই। পানির জীবাণু পরিক্ষার যন্ত্রও নেই। পরিশোধনের যন্ত্র থাকলেও অনেকে সরাসরি লাইনের পানি জারে ভরে বাজারজাত করছে। যা অত্যন্ত ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী।

আব্দুল জব্বার বলেন, রাজধানীর মিরপুরের আরা পিউরিফাইড ড্রিংকিং ওয়াটার কোনো অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা করছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়ে সিলগালা করা হয়। অবৈধভাবে পানি বাজারজাত করায় মালিবাগের ঢাকা ওয়াটার অ্যান্ড বেভারেজকে সিলগালা করা হয়। এছাড়া নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি সরবাহের অভিযোগে সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের উইনার ফ্রেশ ড্রিংকিং ওয়াটার ও ইউবি ড্রিংকিং ওয়াটারকে জরিমানা করা হয়।

তিনি আরো বলেন, দূষিত পানি সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে। অধিদফতরের বেশ কয়েকটি টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। আগামীতে এ অভিযান আরো জরদার হবে।

‘যারাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে’- যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম জানান, জারের পানি নিয়ে গবেষণা করতে ২৫০টি নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানিগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, সংগ্রহ করা নমুনাগুলোতে টোটাল কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৬০০ এমপিএন (মোস্ট প্রবাবল নম্বর) এবং ফেকাল কলিফর্মের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ২৪০ এমপিএন।

টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্ম পরিমাণ পানির সম্ভাব্য দূষণের পরিমাণ নির্দেশ করে। টোটাল কলিফর্ম পরিমাপে পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অন্ত্রে উপস্থিত অনুজীব ও মলমূত্র দ্বারা দূষণের সম্মিলিত মান পাওয়া যায়।

মনিরুল ইসলাম বলেন, কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটোজোয়ার মতো প্যাথোজেন সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগায় বা সৃষ্টি করে। এটি মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেট ব্যথা, জ্বর-ঠান্ডা, বমির মতো নানা উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ষাটোর্ধ্ব মানুষের হেমোলাইটিক ইউরেমিক সিনড্রোম হতে পারে। এ রোগের কারণে ক্রমান্বয়ে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ব্লাড ট্রান্সফিউশন অথবা কিডনি ডায়ালাইসিসের মতো অবস্থা দাঁড়ায়।

চিকিৎসাবিদ অধ্যাপক ডা. এম মুজিবুল হক বলেন, দূষিত পানি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ পানি পান করায় ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, লিভার সিরোসিসসহ নানা মারাত্মক অসুখ হতে পারে। বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ এ দূষিত পানি। যে কোনো মূল্যে দূষিত পানির এ রমরমা বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।

এসআই/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন