ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা প্রমাণিত হচ্ছে

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৪:৪৩ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম । বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক ও ঔপন্যাসিক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষক আন্দোলন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, দুর্নীতিসহ শিক্ষা খাতের নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ‘শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদ চিন্তা জাতিকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে’ বলে মত দেন তিনি।

শিক্ষা ব্যবস্থার চলমান সংকটে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সংবিধানের আলোকে এবং শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন করতে না পারলে অন্ধকার আরো ঘনীভূত হবে।’

জাগো নিউজ : শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন আপনারা। এ দাবির বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শুরু থেকে আমরা বলে আসছি, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ান। মোট বাজেটের ছয় শতাংশের ওপরে শিক্ষায় বরাদ্দ রাখুন। কিউবায় বাজেটের নয় শতাংশ রাখা হচ্ছে শিক্ষা খাতে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকা শিক্ষায় বরাদ্দ বেশি রাখছে। এমনকি নেপালও আমাদের চেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখছে। অথচ শিক্ষা খাতে দুই শতাংশ বরাদ্দের ঘরে আমরা আটকা রয়েছি।

শিক্ষা খাতে যদি বরাদ্দ দুই বা তিনগুণ বাড়ানো যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও গ্রামে গিয়ে স্কুলে পড়াবেন।

জাগো নিউজ : এ জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিকাঠামো দরকার?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : হ্যাঁ, এখন শিক্ষার সমস্যা নিয়ে মোটা দাগে কথা বললে প্রথমেই নীতিকাঠামো নিয়ে আলোচনা করতে হয়। শিক্ষা নিয়ে একটি নীতিকাঠামো আছে, কিন্তু এর কোনো প্রয়োগ নেই। কম্পাসহীন একটি জাহাজের মতো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোনো দিকনির্দেশনা নেই। থাকলে এভাবে আন্দোলন করতে হতো না শিক্ষকদের। দিকনির্দেশনা থাকলে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো-পরীক্ষা পদ্ধতি সবকিছুরই একটি কাঠামো থাকতো এবং এর প্রয়োগ হতো।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষায় যে বরাদ্দ তা খুবই অপ্রতুল। এ বিনিয়োগে বড় কিছু পাওয়া যাবে না। তৃতীয়ত, অসংখ্য পাবলিক পরীক্ষা চালু হলো। কী কারণে এসব পরীক্ষা শুরু হলো তার কোনো মানে খুঁজে পাই না। রমরমা কোচিং বাণিজ্যের স্বার্থেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা পাবলিক করা হলো।

জাগো নিউজ : দুর্নীতির খাদে শিক্ষা। ঘুষ নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যও অবাক করেছে সবাইকে...

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষা খাত দুর্নীতির আখড়া- এটি এখন প্রমাণিত। রোজ খবরে বের হচ্ছে দুর্নীতির কথা। আমি টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডে আছি। দেখেছি, শিক্ষা অধিদফতরে ১৭ ধরনের দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি আছে বলেই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিষ্কার নয়। যে জাতির শিক্ষা পরিষ্কার নয়, সে জাতির কোনো কিছুই পরিষ্কার নয়।

রাষ্ট্র ও সমাজ শিক্ষকদের এমন অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছে, যেন শিক্ষকরা ‘চোখের কাঁটা’। যাদের হাত ধরে জাতি অগ্রসর হবে তাদেরই অপমান করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে বেতন কাঠামোর পরিবর্তন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপমান করা হলো। সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে গিয়ে শিক্ষকদের প্রতি এ অবহেলা বলে মনে করি। ওই কাঠামোতে আমার দুই গ্রেড কমিয়ে দেয়া হলো। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমাদের দিন কোনো মতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হচ্ছেন চতুর্থ ধাপের। প্রাথমিক শিক্ষকরা হচ্ছেন প্রথম ধাপের এবং সেখানেই বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে না।

সার্বিকভাবে শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা প্রমাণিত হচ্ছে। এটি হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে নেতিবাচক চিন্তা। শিক্ষকদের যদি সঠিক মূল্যায়ন না হয়, তাহলে জাতি অগ্রগামী হতে পারে না।

বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। এর সঙ্গে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন, বাধ্য হয়ে। দুর্নীতি বাড়ছে এ খাতে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা পাশ করছে। এতে ওই শিক্ষার্থীর যাত্রা শুরু হচ্ছে দুর্নীতির মধ্য দিয়ে।

জাগো নিউজ : এরপরও তো এগিয়ে যাচ্ছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিক্ষার মূল্যায়ন হচ্ছে। পাশের হার বাড়ানো হচ্ছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাচ্ছে। কিন্তু মানের দিকে নজর নেই। শিক্ষা নিয়ে সরকারের সুস্থ চিন্তা আর নেই। কোনো গঠনমূলক চিন্তা নেই। কোনো একটি বিষয়ে দাবি উঠলে তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, ব্যবস্থা নেয়া হলেও তা হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে।

গ্রামে একজন শিক্ষককে ‘ও মাস্টার’ বলে ডাকা হয়। অনেকটা অবজ্ঞার সুরে। শিক্ষকদের প্রতি এ অবজ্ঞা তৈরি হচ্ছে সরকারগুলোর পরম্পরায়। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি- সবই এক। মূলত আশির দশক থেকে শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা চরম হতে থাকে। এর আগে শিক্ষকদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই যে, তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি দিয়েছেন। এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। আমি যদি প্রধান শিক্ষককে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিতে দ্বিধাবোধ করি, তাহলে শিক্ষার কী মর্যাদা দেবো? উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তার কক্ষের বাইরে বারান্দায় শিক্ষকরা বসে থাকেন আর ভেতরে রাজনীতিক ব্যক্তিদের নিয়ে শিক্ষাকর্মকর্তা মিটিং করেন।

শিক্ষার হার বাড়ছে, নারী শিক্ষার উন্নয়ন ঘটছে, কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়ছে, বছরের শুরুতে নতুন বই দেয়া হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে ইতিবাচক উন্নয়নগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়? শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এভাবে চললে আমরা নিজস্ব গতিতে বেশি দূর যেতে পারবো না। ভারত থেকে সুপার ম্যানেজাররা এসে আমাদের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। আবার আমাদের দেশের রোগীরা ভারতে যাচ্ছেন সেবা নিতে। তার মানে আমাদের ডাক্তারদের প্রতি ভরসা কমে যাচ্ছে দিন দিন।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য আমাদের যে দক্ষতা দরকার তা কমে যাচ্ছে। ভাষাগত জ্ঞান আমাদের দুর্বল হয়ে পড়ছে। এমনকি মাতৃভাষাও এখন ভালো করে শিখতে পারছি না, বলতে পারছি না। ভাষা প্রয়োগে ছন্নছাড়া ভাব। এমন একটি বিক্ষিপ্ত ভাষাজ্ঞান দিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারবো?

প্রযুক্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এগিয়ে দিচ্ছেন কারা? ভারতীয়রা আমাদের প্রযুক্তিতে জ্ঞান দিচ্ছে। ভাষার অদক্ষতার কারণে আমরা প্রযুক্তিতে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে পারছি না।

বাজার নির্ভর বিশ্ব, বিশ্ব অর্থনীতি। কিন্তু সে বাজারে আমাদের অবস্থান নাজুক। আমাদের বাজার দখল করছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ। শিক্ষায় চরম অব্যবস্থাপনার কারণে এমন হচ্ছে।

নৈতিক শিক্ষা, নান্দনিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকেও আমরা অনেক দূরে অবস্থান করছি। বয়স্কদের সম্মান করা, দুস্থদের অবহেলা না করা হলো নৈতিক শিক্ষা। কিন্তু এখন আর সম্মান মেলে না। মাদরাসায় নৈতিক শিক্ষা শেখানো হয়। অথচ মাদরাসা থেকে বেরিয়েও শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

সাংস্কৃতিক শিক্ষার অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে, চরমপন্থা অবলম্বন করছে। বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রবেশ করে আমরা সমস্যা তৈরি করেছি। কিন্তু সম্ভাবনা দেখতে পাইনি। এ কারণে ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার হচ্ছে।

জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির মাঝেও মেধার সঞ্চার হচ্ছে। এটি তো আশা জাগায়...

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি এখনো মনে করি দেশে অনেক মেধাবী আছে। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল তা বলা যাবে না।

শিক্ষার উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের যে সংকল্প থাকা দরকার, তা নেই। শিক্ষানীতির বাস্তাবায়ন অথবা সংবিধানে যে তাগিদ দেয়া আছে, তা নিয়েও রাষ্ট্রের উদাসীনতা আছে। নইলে প্রতিরক্ষা বা অন্য সব খাত থেকে বাজটে কমিয়ে এনে শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল।

জাগো নিউজ : এ ক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রথম শ্রেণি থেকে সৃজনশীল শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে। অনাবশ্যক পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করা এখন সময়ের দাবি। বেসরকারি শিক্ষা হতে পারে, তবে সেটা হতে হবে সরকারের দেয়া কাঠামোর ভিত্তিতে।

একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষা থাকলেও তার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে অনেক মাদরাসা আছে। সেখানকার ছাত্ররা ভারতের আইসিটিতেও পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করছেন। পশ্চাৎপদ চিন্তা বাদ দিতে হবে। আমরা মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বড় অবহেলা করি। অথচ তারাও আমাদের সম্পদ। বড় কষ্ট হয় তাদের দুরাবস্থা দেখে।

শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আনতে হবে এবং সেটিই হচ্ছে এখন একমাত্র উপায় পরবর্তী ধাপে উত্তরণের জন্য। বাজেট বাড়লে, শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসলে আমরা শিক্ষা অর্জনে ভারতকেও পেছনে ফেলতে পারবো।

জাগো নিউজ : হতাশার মধ্যেও আশার বাণী...

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়াচ্ছেন, তারা কিন্তু এ দেশের-ই। তারা বাইরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাঠদান করছেন। বেতন বেশি পাচ্ছেন বলে আনন্দের সঙ্গে পড়াচ্ছেন। বেতন বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে যদি গ্রামের স্কুলে নিয়োগ দেয়া যায়, তাহলে ওই গ্রামে অনেক আলোকিত শিক্ষার্থী বের হবে। রাষ্ট্রীয় সংকল্প থাকলেই সব সম্ভব।

সমাজ তো শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। বিনিয়োগও করতে চায়। শুধু রাষ্ট্রের ওপর অভিভাবকরা নির্ভরশীল নয়। দরকার শুধু সমন্বয় ও সদিচ্ছা। ডিজিটালাইজেশন করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সেবা দিতে হবে। ভারত পারলে, শ্রীলংকা পারলে আমরা পারবো না কোনো? নারীদের শিক্ষকতা পেশায় আরো উৎসাহিত করতে হবে, সুযোগ দিতে হবে। নারীরা শিক্ষার্থীদের সন্তানতুল্য মনে করেন।

সবার আগে শিক্ষাকে পণ্য ভাবা বন্ধ করতে হবে এবং শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যিক যে চিন্তা তা দ্রুত ত্যাগ করতে হবে। এটি করতে পারলেই আমাদের মুক্তি।

এএসএস/এমএআর/আইআই

আরও পড়ুন