বাড়ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, পুনঃপরীক্ষার আওতায় নেই ৫০ শতাংশ
সারাদেশে প্রায় তিন লাখ সিএনজি চালিত যানবাহন রয়েছে। এসব যানবাহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত সিলিন্ডার প্রতি ৫ বছর পরপর রিটেস্ট (পুনঃপরীক্ষা) করার বিধান রয়েছে। সকল ধরনের সিলিন্ডারের রিটেস্টের অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। তবে সিলিন্ডারের রিটেস্ট করাতে হয় অন্য প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও আইনে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সিলিন্ডারের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলছে।
বিস্ফোরক অধিদফতর বলছে, সিএনজি চালিত যানবাহনের নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডার ৫ বছর পরপর রিটেস্টের বিধান রয়েছে। তবে মাত্র ৫০ শতাংশ যানবাহনের সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার আওতায় রয়েছে। বাকিগুলোর পুনঃপরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ভয়াবহ তাজা বোমার ন্যায় কাজ করে। আইন করে বিআরটিএর ফিটনেস নেয়ার সময় সিলিন্ডার রিটেস্ট করানো বাধ্যতামূলক করা হলে বহুলাংশেই এ ঝুঁকি কমবে। সরকারের উচিত খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিস্ফোরক অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যানবাহনের সিলিন্ডার রিটেস্ট বাধ্যতামূলক করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যাচাই-বাছাই শেষে মন্ত্রণালয় আরও সময় নিয়ে বিষয়টি বাস্তবায়নের কথা জানায়। এরপর আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। আইনে বাধ্যবাধকতা না থাকায় ও বিআরটিএ-এর কাঙ্ক্ষিত মানের পরীক্ষা ও অভিযান না থাকায় সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। জীবনের ঝুঁকি স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র অসচেতনতার কারণে যানবাহনের মালিকপক্ষ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করছেন না।
তারা আরও বলেন, এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই গণপরিবহনের চালক, মালিক এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের। অনেক চালক-মালিকই জানেন না ঠিক কবে তার গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার লাগানো হয়েছে বা কখনো পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না।
ট্রাফিক বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের (২০১৭) ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারে অগ্নিকাণ্ডে আরেকটি বাস পুড়ে যায়। দুটি ঘটনাতেই কোনো যাত্রী হতাহত না হলেও শাহবাগের ঘটনায় বাস চালকের হাত ও পা পুড়ে যায়। এক সপ্তাহ না যেতেই আবারও মগবাজার ফ্লাইওভারে আরেকটি বাসে আগুন ধরে। ঘটনার পর পর সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বাসগুলোতে আগুন লাগে।
গত এক মাসে রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশাসহ সাতটি যানবাহনে সিলিন্ডারের ক্রটিজনিত কারণে আগুন লেগে যায় বলে রিপোর্ট দিয়েছে বিস্ফোরক অধিদফতর। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাইওয়ে পুলিশ এ বিষয়ে সহযোগিতা করবে।
দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই এসব লাইসেন্স দেওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। রূপান্তরিত সিএনজি চালিত যানবাহনের অনুমোদন বিআরটিএ দেয়। এ জন্য দুর্ঘটনার দায় বিআরটিএ এড়াতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় যদি সমন্বয় করে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারের ফিটনেস দেখা ও সার্টিফিকেট চেক করা হয় তাহলে বাধ্য হয়ে মালিকপক্ষ তাদের যানবাহনে ব্যবহৃত সিলিন্ডার রিটেস্ট করাবেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।
এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে দুই বছর আগে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
তিনি বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানিতে (আরপিজিসিএল) সিএনজি কনভারশন ও রিটেস্টিং করে থাকে। সারাদেশে ৫৮৭টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে রিটেস্ট সেন্টার ছিল ১৪টি। তা এখন বেড়ে হয়েছে ১৯টি। কিন্তু এরপর আর সংখ্যা বাড়েনি।
সামসুল আলম আরও বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে আইন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। পানির ফিল্টারের ঢালার আগে যদি ছাকনি ব্যবহার করা না হয় তাহলে ময়লা পানিতে কীটও নষ্ট হতে পারে। যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় বিআরটিএ। বিআরটিএ ফিটনেস পরীক্ষার সময় যদি সিলিন্ডার পরীক্ষাটাও সম্পন্ন করা যায় তাহলে পরবর্তীতে আর সমস্যা হয় না। কিন্তু এ সমন্বয়টিই আর হচ্ছে না।
বিআরটিএ যখন যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করে তখনই যদি বিআরটিএ অথবা যৌথ উদ্যোগে সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হয় তাহলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের দুর্ঘটনা কমে আসবে। এ জন্য প্রয়োজনে আইনও করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহবুব-ই-রববানীন সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে বিআরটিএ-এর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. নুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ফিটনেস পরীক্ষার সময় সবকিছুই দেখি। প্রত্যেকটি যানবাহনের সিলিন্ডারের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে কিনা তার কাগজপত্র দেখি। যদি সিলিন্ডার পরীক্ষার মেয়াদোত্তীর্ণ হয় তাহলে রিটেস্ট করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে বলি। সিলিন্ডারের ফিটনেস না থাকলে আমরা ফিটনেস সার্টিফিকেট দেই না।
জেইউ/আরএস/জেআইএম