আছি, থাকবো, মানুষকে নিয়েই : শামীম ওসমান
শামীম ওসমান। সরকার দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিশেষ আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়েই দেশের পরিচিত মুখ। ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন। আলোচনার পাশাপাশি তাকে নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বহু।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফুটপাতের হকার উচ্ছেদ নিয়ে ফের আলোচনায় এসেছেন প্রভাবশালী এ সংসদ সদস্য। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় এমপি শামীমের সমর্থকদের। সংঘর্ষে আহত হন মেয়র আইভীও।
সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজ-এর মুখোমুখি হন শামীম ওসমান।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে আপনার দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে। দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হলেন আইভী নিজেও। এ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
শামীম ওসমান : রাজনীতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। নারায়ণগঞ্জের ফুটপাতে যে সব হকার ব্যবসা করেন তাদের অবস্থা ‘দিন আনে দিন খায়’ গোছের। এরা বেশির ভাগই এনজিও’র ঋণ অথবা অন্যের কাছ থেকে ধার করা টাকায় ব্যবসা করেন।
ঘটনা গত ২৫ ডিসেম্বরের। একটি শুভ দিন। হঠাৎ হকারদের উচ্ছেদ করা হলো এবং কারও কারও মালামাল নিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো। পরের দিন উচ্ছেদকৃত হকাররা আমার কাছে এসে কান্না করলেন।
আমি তাদের মেয়রের কাছে ফের যাওয়ার পরামর্শ দিলাম। বললাম, স্থায়ীভাবে নয়, সাময়িকভাবে আপনারা ফুটপাতে বসার অনুরোধ জানান। আমি জানি, এ মানুষগুলোর ভোটেই আইভী এবং আমি নির্বাচিত হয়েছি। তাদের পেটে লাথি মারলে রাজনীতির বদনাম হবে, সরকারের বদনাম হবে।
জাগো নিউজ : মেয়রের কাছে গিয়েছিলেন হকাররা?
শামীম ওসমান : একবার নয়, হকাররা তিনবার গিয়েছিলেন। মেয়র হকাররদের কথা শুনলেন না। এর মধ্যে বামমোর্চার নেতারা নারায়ণগঞ্জে আসলেন। তারা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাদের বক্তব্য, সরকার গরিব মানুষের পেটে লাথি মারছে। এর দায় তো সরকারের প্রধানের ওপরেও পড়ে।
আমি তখন প্রশাসনকে বললাম, এ গরিব মানুষেরা এখন যাবে কোথায়? উচ্ছেদ করার ২৫ দিন পর দেখলাম, হকাররা কোথাও যেতে পারেনি।
এরপর ৪ জানুয়ারি একটি মিটিং আহ্বান করা হয় যেখানে আমাকেও ডাকা হয়। সেখানে গিয়ে এমন মানবিক দৃশ্য দেখেছি, যা আমাকে চরম লজ্জা দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। বৃদ্ধ মানুষেরা পা ধরে অঝোরে কাঁদলেন। একেবারে হৃদয়বিদারক ঘটনা। অথচ প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পুনর্বাসন ছাড়া কোনো প্রকার উচ্ছেদ করা যাবে না।
আমি প্রশাসনকে বললাম, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা করুন। নইলে তারা ফুটপাতেই বসবে। আছি, থাকবো, মানুষকে নিয়েই।
জাগো নিউজ : এরপর কী ঘটলো?
শামীম ওসমান : মেয়র আইভী আমার কথা হয়ত বুঝতে পারেননি। তিনি কয়েকশ’ সমর্থক নিয়ে রাস্তায় নামলেন এবং হকারদের মারপিট করতে শুরু করলেন।
জাগো নিউজ : মারপিট আপনার লোকেরাই আগে শুরু করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়াজুল নামে আপনার এক সমর্থক অস্ত্রও প্রদর্শন করলেন।
শামীম ওসমান : রাজনীতির সঙ্গে নিয়াজুলের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। সে ব্যবসা করে। তার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে বিএনপির আমলে ক্রসফায়ারে নিহত সুইটের ভাই। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী সুইটকে জেলখানা থেকে বের করে এনে র্যাবকে দিয়ে ক্রসফায়ার দিয়েছিল বিএনপি ক্যাডাররা।
ঘটনার দিন সে গাড়ি নিয়ে আসছিল। জ্যাম ছিল বলে, গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে আসছিল। তাকে পেয়েই অমানবিক নির্যাতন করা হলো। তিন বার ফেলে মারপিট করা হলো।
জাগো নিউজ : নিয়াজুল তো অস্ত্রধারী? অস্ত্র প্রদার্শনও করলো?
শামীম ওসমান : তার অস্ত্র বৈধ। প্রদর্শন করলেও সে কিন্তু ফায়ার করেনি। বারবার মারপিট করা হলেও সে ফায়ার করেনি। ফুটেজে সবই আছে। সে মেয়রকে হত্যা করতে যায়নি। বরং নিয়াজুলকেই বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে, নিয়াজুল আপনার পক্ষে ছিল?
শামীম ওসমান : অভিযোগ তো আরো অনেক। আমি বিশাল গডফাদার। বিশাল ফ্যাক্টর। তো একমাত্র নিয়াজুলকেই কেন পাঠালাম? তার পক্ষে আর কেউই থাকবে না?
আমার পক্ষ থেকে গেলে তো ওর সঙ্গে আরও লোক থাকতো। একা কেন?
জাগো নিউজ : তাহলে নিয়াজুল রোষানলে পড়ার কী কারণ থাকতে পারে?
শামীম ওসমান : প্রথমে আইভীর খুব কাছের লোক সুফিয়ান নিয়াজুলকে সরিয়ে দিয়ে রক্ষা করলো। এরপর আইভীর এক বোনের স্বামী তাকে উদ্ধার করতে এলো।
জাগো নিউজ : তাহলে মারপিট করলো কারা?
শামীম ওসমান : এখানেই প্রশ্ন। বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। একা পেয়ে মেয়রের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ফায়ার করলো। একে একে তিনবার মারা হলো।
নিয়াজুলের ভাগ্নে রক্ষা করতে গেলে তার মাথায়ও আঘাত করা হলো। তার ভাগ্নে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো। বিএনপি’র আমলে ক্রসফায়ারে নিহত সুইটের ভাই নিয়াজুল, সঙ্গত কারণে সহমর্মিতা ছিল সাধারণের। সংঘর্ষটা ঠিক এখান থেকেই। নিয়াজুলকে মারপিট না করা হলে সংঘর্ষের ঘটনাই ঘটতো না।
জাগো নিউজ : মেয়রের ওপর তো হামলা করলো আপনার কর্মীরা?
শামীম ওসমান : নিয়াজুলকে মারপিটের পর বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় কোনো বিশেষ ঘটনাকে আলাদা করে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। তবে মেয়রকে আমার সমর্থকেরা আঘাত করেছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
জাগো নিউজ : এখন হকারদের পরিস্থিতি কী?
শামীম ওসমান : প্রশাসন হকারদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছে বলে জেনেছি। তারা সেখানে বসেছে, এমনটি শুনেছি।
পৃথিবীর সব দেশেই হকার আছে। ভারতের গ্রান্ড হোটেলের সামনেও হাকার আছে। তারা শখে রাস্তায় বসে ব্যবসা করেন না। উচ্ছেদ করতে হলে তাদের বেঁচে থাকার পথও বের করতে হবে। বাস্তবতার বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত মানবো না।
জাগো নিউজ : এ ঘটনা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি-না?
শামীম ওসমান : অবশ্যই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি। আওয়ামী লীগের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।
জাগো নিউজ : এ দ্বন্দ্ব নিরসনে আপনার কোনো চেষ্টা আছে কি-না? আপনি আইভীর পাশে থাকার কথা বলেছিলেন?
শামীম ওসমান : আমি আইভীকে কীভাবে জিতিয়ে এনেছি, তা আপনার মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজের কাছে বলেছিলাম। কী কী করেছি, সবই জানেন। সে গেলো এক বছরেও আমাকে সাধুবাদ পর্যন্ত জানায়নি। আমার ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে আইভীর বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে বসতে বলা হয়নি, এক কাপ চা খাওয়ায়নি। তার জন্য কোনো প্রকার দুঃখ নেই।
সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে বিএনপি’র আমলের একটি প্রজেক্টের জন্য ৬শ’ কোটি টাকার বাজেট পাস করে এনে দিয়েছি। কে কার জন্য কাজ করছেন, তা জামায়াত-শিবিরের বাঁশের কেল্লা দেখলেই বোঝা যায়।
জাগো নিউজ : ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইভী এবং আপনাকে নিয়ে বসার কথা ছিল?
শামীম ওসমান : এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আমি কারও সঙ্গে বসিনি।
জাগো নিউজ : মেয়র আইভীর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন?
শামীম ওসমান : খোঁজ নিয়েছি। ভালো আছেন মেয়র আইভী।
এএসএস/এসএইচএস/আরআইপি