মেধাবীরা আসছে, ওরাই বদলে দেবে পুলিশকে
২০১৫ সালের ১ জানুয়ারিতে এ কে এম শহীদুল হক পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব নেন। তার মেয়াদকালেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ঘটেছে গুলশান ট্র্যাজেডির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে তার মেয়াদ। মেয়াদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে রোববার জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
জাগো নিউজ : কেমন করছে পুলিশ?
আইজিপি : পুলিশের ভালো করার শেষ নেই। তবে আমার মনে হয় পুলিশের আচরণগত কিছু পরিবর্তন দরকার। থানা পর্যায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এখনও অনেক অভিযোগ। সেগুলোর তদন্ত করে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পুলিশ যেনো কাউকে হয়রানি না করে, জনগণ যেনো থানা থেকে দ্রুত সেবা পায় সেটা নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। থানায় অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সেখানে জনবল ও পরিবহন সুবিধা কম। যে কারণে অনেক সময় জনগণকে দ্রুত সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও থানা পুলিশ কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে। কারণ, থানা পুলিশকে সাধারণ মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে। সুতরাং জনগণের আস্থা ধরে রেখে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
জাগো নিউজ : অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের নানা অপরাধ ও অনিয়ম বাহিনীর অর্জনকে ম্লান করে দেয়। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আইজিপি : পুলিশ বড় একটি বাহিনী, আড়াই লাখ জনবল। সেখানে তো ভালো-মন্দ থাকতেই পারে। আর আমরা তো ভালো দেখেই নিই। ভালো দেখে নেয়ার পর যে কোনো কারণে কারো নৈতিকতার স্খলন হতে পারে। অপরাধে জড়াতে পারে। কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় অ্যাকশন নেয়া হয়। ফৌজদারি অপরাধ হলে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ধরনের নমনীয় দেখায় না। তবে কোনো ব্যক্তির দায় তো বাহিনী নেবে না।
‘পুলিশ সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো জীব নয়, বরং সমাজের একটি অংশ। সমাজের অনেক কিছু পুলিশকে প্রভাবিত করে। রাজনীতি বলেন আর সামাজিক জীবন বলেন না কেন, সমাজ ভালো হলে পুলিশও ভালো হবে। সমাজকে বাদ দিয়ে শুধু পুলিশকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তার সুযোগ নেই। পুলিশকে সহযোগিতা করতে হবে।’
বাংলাদেশ পুলিশের জবাবদিহি নিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, পুলিশের তো পদে পদে জবাবদিহি। পুলিশকে আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। জবাবদিহির বাইরে কেউ নেই।
থানা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেসব জনগণ সরাসরি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ‘ওপেন ডে হাউস’ বৈঠকের সরাসরি উত্থাপিত হয়। সব ধরনের অপরাধের শাস্তি পেতে হয়। ছোট-বড় যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই, যার যা এখতিয়ার সে অনুযায়ী শাস্তি দেয়। দায়িত্ব অনুযায়ী সার্কেল এএসপি, এসপি, ডিআইজি এবং পুলিশ সদর পর্যায়ক্রমে শাস্তি দিয়ে থাকে।
জাগো নিউজ : জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা কতটুকু?
আইজিপি : জঙ্গি দমনে পুলিশ যথেষ্ট সফলতা ও সক্ষমতা দেখিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে ‘অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট’। জনবল নিয়োগ দিয়ে এ ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের জন্য সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার বাজেটও অনুমোদন হয়েছে। আগামীতে যা যা করা দরকার সবই করা হবে। জনসম্পৃক্ত কাজে পুলিশ সবসময় এগিয়ে থাকবে।
জাগো নিউজ : জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি-না?
আইজিপি : জঙ্গিদের সুস্থ ও স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনতে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া জেলখানা থেকে শুরু করতে হবে। যেসব জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আমরা জেলখানায় পাঠাই তারা বেরিয়ে যেনো ফের জঙ্গিবাদে না জড়ায় সেজন্য তাদের মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে হবে। মনোবিজ্ঞানী, ডাক্তার, ধর্মীয় নেতা ও সমাজবিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিতভাবে যদি তাদের মোটিভেট করা যায় তাহলেই জঙ্গিদের পুনর্বাসন সম্ভব।
জাগো নিউজ : দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন?
আইজিপি : শুধু জঙ্গি দমন নয়, প্রতিটি অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ সফলতা দেখিয়েছে। ২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে গোটা বাংলাদেশে অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। আমি ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়েছি। ২০১৪ সালের সঙ্গে ২০১৫ সালের তুলনা করলে কিংবা আগের বছরের সঙ্গে পরবর্তী বছরের তুলনা করলে পুলিশের সফলতা বেশি। মাদকের ব্যাপারে প্রচুর মামলা হয়েছে। এটি পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও মাদকের ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে।
জাগো নিউজ : আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের অপরাধ হ্রাস করতে পারলেও মাদক বন্ধ হয়নি, এর পেছনে কী কী কারণ আছে বলে মনে করেন?
আইজিপি : মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের অনেক সফলতা রয়েছে। তবে পুলিশের একার পক্ষে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। যদিও সিংহভাগ কাজ পুলিশকেই করতে হয়। মাদক নির্মূলে আলাদা বিভাগ আছে। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একসঙ্গে মাদক নির্মূল করতে হবে।
জাগো নিউজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীকে জঙ্গিবাদসহ সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য অন্য বাহিনীর সঙ্গে বিনিময় করার কথা বলেছেন। অন্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ কীভাবে তথ্য বিনিময় করছে?
আইজিপি : গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ রয়েছে। স্ব-স্ব কমিটিও রয়েছে। কমিটি সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময় করছে। এছাড়াও গোয়েন্দা শাখার প্রধান, কমিশনার অফিস, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় হচ্ছে।
জাগো নিউজ : দেশের যে কোনো এলাকা থেকে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ দেয়ার জন্য খোলা হয়েছিল আইজিপি কমপ্লেইন সেল। সেলের কার্যক্রমের বিষয়ে জানাবেন?
আইজিপি : সেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। তার কাছে ২৪ ঘণ্টা লিখিত, মেইলে ও টেলিফোনে অভিযোগ আসে। তিনি সব অভিযোগ আমাদের ডিসিপ্লিন সেকশনের অতিরিক্ত ডিআইজিকে জানান। তারা আমার কাছে নিয়ে আসেন। আমি সেসব অভিযোগ বুঝে গুরুত্ব অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করি। তদন্ত সাপেক্ষে তিন অথবা সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলি। ছোট-বড় মিলে প্রতিদিন শতাধিক অভিযোগ পাই, এজন্য একটা সেলই আছে।
জাগো নিউজ : আইজিপি কমপ্লেইন সেলে কী ধরনের অভিযোগ আসে?
আইজিপি : সাধারণত থানায় পুলিশের মামলা না নেয়া, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে টাকা চাওয়া, অভিযোগ করার পরও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া, খারাপ ব্যবহার ইত্যাদি।
জাগো নিউজ : তিন বছর আইজিপি হিসেবে কতটুকু তৃপ্ত?
আইজিপি : ভালো কাজের প্রশংসা আর খারাপ কাজের সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। আইজিপি থাকা অবস্থায় আমি নাগরিকদের সেবার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ চালু করেছি। এতে মানুষকে আর হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না। আগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নেয়ার জন্য কয়েকবার এসপি অফিস, থানা পুলিশে ঘুরতে হত। এখন অনলাইনে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যাচ্ছে। সব এখন অনলাইনে করা যাচ্ছে। একবার গেলেই সব পেয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীদের জন্য কল্যাণ ডেস্ক, হেল্প ডেস্ক খুলেছি। বিদেশ থেকে ইন্টারনেট ও এসএমএসের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছি। সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। সব সময় চেষ্টায় রয়েছে, দ্রুত কীভাবে জনগণকে সেবাটা দেয়া যায়।
পুলিশকে গণমুখী, জনবান্ধব ও গণতান্ত্রিক করার জন্য গত তিন বছর ধরে কমিউনিটি পুলিশিংকে জোর দিয়েছি। আমার মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের কাছে পুলিশকে নিয়ে যাওয়া। পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আমি মনে করি, আগের তুলনায় পুলিশের সক্ষমতা ও দক্ষতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরাপদ বলেই দেশে অনেক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান সেমিনার সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়েও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো রাখতে সক্ষম হয়েছি।
জাগো নিউজ : জনগণের সেবায় পুলিশের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
আইজিপি : আমি চাই পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে দূরত্ব যেনো না থাকে। পুলিশ নাগরিকদের জন্য কাজ করে। যাদের জন্য সেবা দিচ্ছি তাদের সঙ্গে দূরত্ব থাকলে সেবা মূল্যায়িত হবে না। জনগণ কী ধরনের সেবা আশা করে সেটিও আমার জানা দরকার। এজন্য আমি কমিউনিটি পুলিশিং করেছি। জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে প্রতিটি ইভেন্টে মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি। এভাবে সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে সম্পর্ক বাড়বে এবং ভীতি জড়তা কমে যাবে। যখনই আস্থা কমে যাবে তখনই এ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশলে সাহায্য সহযোগিতা পাবো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্য দেবে তারা।
পুলিশ সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হলে পুলিশকে সেবা দেয়ার মানসিকতা বাড়াতে হবে। সেবা দেয়ার যে প্রক্রিয়া সেখানে যেমন পরিবর্তন আনতে হবে তেমনি মানের ক্ষেত্রেও উন্নতি করতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবার মান ও পরিধি বাড়াতে হবে। জনগণ এখন তাই পুলিশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। পুলিশের কাজের সুনাম করছে। এটাই এখন পুলিশের জন্য ইতিবাচক। একজন পুলিশের স্বপ্ন হওয়া উচিত সেবা দেয়ার মাধ্যমে জনগণের স্বীকৃতি অর্জন করা। এ লক্ষ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।
পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে। এখন পুলিশে অনেক মেধাবী ও ভালো ছেলেরা আসছে। তারা ভালো কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের কারণে প্রশাসনে গতি বেড়েছে। আশা করছি তারা পুলিশকে আরও বদলে দেবে।
এআর/জেইউ/জেডএ/এআরএস/এএইচ/জেআইএম