স্থগিত মেডিকেলেও ভর্তি চলছে : হয় রাজনৈতিক বিবেচনা, না হয় রিট
নয়টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত স্থগিতাদেশ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানে নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। গত বছরের অক্টোবরে এই নয়টি বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিতে স্থগিতাদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এসব মেডিকেল কলেজ প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করলে কোনো অবস্থাতেই চলতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনোটির ওপর থেকে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেই ‘শর্তসাপেক্ষে’ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে। আবার স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছে এমন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি অব্যাহত রেখেছে।
যেসব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আদালতে রিট করে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবগুলোই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় মেধাতালিকা অনুসরণ না করেই শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। এমনকি, সরকার নির্ধারিত ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকার দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে।
বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ছাত্রী-ছাত্রীর সংখ্যানুপাতে শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির কারণে গত বছরের ২৬ অক্টোবর নয়টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করা হয়।
কলেজগুলো ছিলো- রংপুরের নর্দান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ, ঢাকার আদ্-দ্বীন বসুন্ধরা মেডিকেল কলেজ, আশিয়ান মেডিকেল কলেজ, সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ, নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কেয়ার মেডিকেল কলেজ, আইচি মেডিকেল কলেজ ও সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজ।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুইটি বেসরকারি মেডিকেল ও একটি ডেন্টাল কলেজসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০১৭-২০১৮) এমবিবিএস প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে। এগুলো হলো- কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ, গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ এবং রাজধানীর মালিবাগের সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজ।
অপরদিকে, চারটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি স্থগিতাদেশ বহাল রয়েছে। এগুলো হলো, রাজধানীর খিলক্ষেতের আশিয়ান মেডিকেল কলেজ, ধানমন্ডির নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, আইচি মেডিকেল কলেজ এবং কেয়ার মেডিকেল কলেজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে জানান, স্থগিত ঘোষিত নয়টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের কোনোটির ওপর থেকেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেই। তবুও রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তারা বলেন, গাজীপুর সিটি মেডিকেলের মালিকানায় বর্তমান সরকারের আমলের সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রয়েছেন। মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজের মালিকানার সঙ্গেও বিএসএমএমইউয়ের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা শিক্ষক (জাসদ নেতা) জড়িত। সব কয়টি মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনুমতি দেয়ার জন্য সুকৌশলে ‘শর্ত সাপেক্ষে’ বলা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয়া হলে স্থগিত ঘোষিত অন্যগুলোও অনুমতি পাওয়ার দাবিদার। এসব কারণ উল্লেখ করেই আদালতে রিট করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে স্থগিত মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
উচ্চ আদালতে রিট করে যেসব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ শিক্ষার্থী ভর্তি করছে তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে এরইমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্থগিত মেডিকেল কলেজে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি অব্যাহত থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো.আবদুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, শর্ত সাপেক্ষে কিছু মেডিকেল কলেজের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ না করলে ভর্তি স্থগিতসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে যেগুলো উচ্চ আদালতে রিট করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে, সেগুলো আইনিভাবেই মোকাবেলা করা হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সাতটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও বহালের সিদ্ধান্ত হয়। শর্ত সাপেক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারকৃত কলেজগুলোকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে শর্ত পূরণের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেয়া হয়।
বসুন্ধরা আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ
রাজধানীর উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের এ কলেজকে চারটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। শর্তগুলো হলো, মেডিকেল কলেজের নিজস্ব নামে নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চার একর জমি ‘বসুন্ধরা আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’এর নামে রেজিস্ট্রিমূলে নাম জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ২৫০ এ উন্নীত ও প্রত্যেক ওয়ার্ডে শতকরা ১০টি শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণ করে মার্কিং; বিএমডিসির শর্তানুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ এবং গ্যালারির আধুনিকায়ন ও বেড অকুপেন্সি বৃদ্ধি।
গাজীপুর সিটি মেডিকেল কলেজ
এক ডজন শর্ত পূরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গাজীপুর সিটি মেডিকেল কলেজের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় আমানতের এক কোটি টাকা তফসিলি ব্যাংকে জমা দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত এবং গচ্ছিত টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া উত্তোলন করা যাবে না এই মর্মে ব্যাংক হিসেবে বিশেষ নির্দেশাবলী প্রদান করা; গাজীপুর এলাকায় মেডিকেল কলেজের নিজস্ব নামে নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চার একর জমি প্রতিষ্ঠানের নামে রেজিস্ট্রিমূলে নাম জারি করে ৩০ জুনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সুবিধা সম্বলিত তিন লাখ ২০ হাজার বর্গফুটের ব্যবস্থা আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে করা; এ বিষয়ের অগ্রগতি তিন মাস পরপর মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; আগামী ৩০ মার্চের মধ্যে ৪০০ শয্যার হাসপাতালের লাইসেন্স স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৪০০ উন্নীত ও প্রত্যেক ওয়ার্ডে শতকরা ১০টি শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণ করে মার্কিং করা; আগামী ৩০ মার্চের মধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ; প্রতি তিন মাসে একবার গর্ভনিং বডির সভা করে তা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; সুষ্ঠুভাবে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুসজ্জিত ল্যাব ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বই রাখা; আগামী ৩০ জুনের মধ্যে জেনারেটরসহ লিফট স্থাপন করা; শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের মনিটরিং করা এবং পরামর্শকদের পক্ষে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা;ড় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের যাবতীয় তথ্য রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব শর্ত পূরণ না হলে অনুমোদন বাতিলের শর্ত।
সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজ
ডেন্টাল কলেজের নিজস্ব নামে নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জমি বেসরকারি ‘সাফেনা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল’ এর নামে রেজিস্ট্রিমূলে নাম জারি করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে অবহিত করা; ডেন্টাল শিক্ষার জন্য কলেজ ও হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত নীতিমালা অনুসারে ফ্লোর স্পেসের ব্যবস্থা করা; এ বিষয়ে অগ্রগতি তিন মাস পর মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা; হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রত্যেক ওয়ার্ডে শতকরা ১০টি শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণ করে মার্কিং করে রাখা এবং বিএমডিসির নীতিমালা অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া।
এমইউ/এসআর/জেআইএম