ভিক্ষুক থেকে সমৃদ্ধির পথে
জীবন চলত অন্যের অনুকম্পায়। অসুস্থতার কারণে অন্যের দুয়ারে দুয়ারে যেতে না পারলে থাকতে হতো অনাহারে। ভিক্ষাবৃত্তি যখন নিত্য ঘটনা তখন কেউ ফিরিয়ে দিত, কেউবা করুণা করত যৎসামান্য, যা পাওয়া যেত তা দিয়ে পেট চালানোই কঠিন, সেখানে স্বাস্থ্য, বস্ত্র তো অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু এখন ঘুচে গেছে দুঃখ, বদলে গেছে সেই দিন। পরনির্ভরশীল সেই ভিক্ষাবৃত্তির জীবনের অবসান হয়েছে, জীবনমান এখন সমৃদ্ধির পথে।
সুফিয়া খাতুন। যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার বাড়ি জয়পুরহাট জেলার নিক্তিপাড়া গ্রামে। সরেজমিনে তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কীভাবে তিনি সচ্ছল জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, দরিদ্র দিনমজুর পরিবারে জন্ম তার। অভাবের সংসারে ঠিক মতো খাবারও জুটত না। একটু বড় হওয়ার পর অন্যের বাড়িতে কাজ করার জন্য তাকে রেখে আসা হয়। এরপর মাত্র ১২ বছর বয়সে পাশের নিত্তিপাড়া গ্রামের মকবুল হোসেন নামে এক ভ্যান চালকের সঙ্গে বিয়ে হয় সুফিয়ার। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে নিয়ে নিত্তিপাড়া গুচ্ছগ্রামে একটি জীর্ণ বেড়ার ঘরে আশ্রয় নেন।
২০০২ সালে মকবুল পঙ্গু হলে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সুফিয়ার। একপর্যায়ে সুফিয়া বেছে নেন ভিক্ষার পথ। সারাদিন ভিক্ষা করে মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকে সংসার। চিকিত্সার অভাবে ২০০৮ সালে মকবুল মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ে সখিনাকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। কোনো উপায় না পেয়ে গাইবান্ধা জেলার কামদিয়া এলাকার একজন দিনমজুরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন।
এতে তার কষ্ট আরও বেড়ে যায়। এই অবস্থায় ২০১০ সালে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সমৃদ্ধি কর্মসূচি ধলাহার ইউনিয়নে জরিপের মাধ্যমে ১০৪ জন ভিক্ষুকের একটি তালিকা করে। পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনায় গঠিত কমিটির সার্বিক যাচাই-বাছাই শেষে সুফিয়ার পরিবারকে পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য মনোনীত করা হয়। ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় জাকস ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেয়ার মৌখিক ও লিখিত চুক্তির মাধ্যমে দুটি গাভি ও একটি বাছুর কিনে দেয়। আর এর মাধ্যমে নিজেকে আয় বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে জীবনযুদ্ধে হার না মানা সুফিয়ার ভিক্ষাবৃত্তির অবসান ঘটে। বর্তমানে দুটি গাভি দুটি বাছুরের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ কেজি দুধ হয়। ওই দুধ বিক্রি করে মাসিক আয় আসে ৫ হাজার ২৫০ টাকা। এছাড়া মুরগী, কবুতর, বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ থেকে প্রচুর আয় হয় তার। বর্তমানে সুফিয়ার বাড়িটি একটি সুন্দর সমৃদ্ধ বাড়ি।
সুফিয়ার আর কোনো দুঃখ নেই। সবসময় তার চোখে-মুখে হাসি লেগেই থাকে।
একই গ্রামের আবু বক্করও দেখেছেন সুখের মুখ। ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন ২০ বছর। ছিলেন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে একজন। এমন কি প্রতিবেশীর কোন অনুষ্ঠান হলেও পেতেন কোন দাওয়াত। উল্টো মিলত তুচ্ছ তাচ্ছিলতা। এখন সেই অবস্থা আর নেই। দিন বদলেছে। আশপাশের প্রতিবেশীদের তুলনায় তিতি কম আয় করেন না। এতে সমাজে তার অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক এই অবস্থান পরিবর্তনের পিছনে ভূমিকা রেখেছে পিকেএসএফের সম্মৃদ্ধি কর্মসূচি।
এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে সারেরা আমাকে টাকা দেন। আমাকে প্রজনন সেন্টার দিতে সহায়তা করে। দুইটা ষাঁড় ও একটি পাঠা দিয়ে প্রজনন কাজ করা হয়। ছাগল প্রজনন করতে একশন টাকা ও গরু প্রজনন করতে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা নেয়া হয়। চীনা হাঁস ও রাজহাঁস পালন করি আমি। সারেরা নিজমিত আমাকে পরামর্শ দেন। খোঁজখবর নেন। ভিক্ষা করা কতটা ছোট কাজ সেটা আমি জানি। আমাকে সবসময় অবহেলিত লাগত মানসিকভাবে আমার সবসময় একটা ব্যথা থাকত। আমি এখন ভালো আছি। আমার পরিবার নিয়ে আমি ভালো আছি। সমাজে আমার একটা ভালো অবস্থান আছে। আমাকে দেখে অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে।
এ বিষয় পিকেএসেফের কর্মসূচি বাস্তবায়নে দায়িত্বে থাকা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, এটা আমাদের অন্যতম প্রজেক্ট। তাদের এ সফলতা ধরে রাখা এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তারা যেন আবার অর্থিক অসুবিধায় না পড়ে সেজন্য আমাদের টিম তাদের দেখাশুনা করছে। ভিক্ষা একটা লজ্জাকর বিষয়। তাদের এ পেশা পরিবর্তন করে টেকসইভাবে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন’ শীর্ষক এক প্রকল্প নেয় পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। তারা প্রতি ভিক্ষুককে এক লাখ টাকা দেয়। নিক্তিপাড়া, ধলাহার আওতায় জাকস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইউনিয়নে ১০ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন অায়বর্ধক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পিকেএসএফ সূত্র জানায়, দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে দরিদ্র পরিবারসমূহের সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি (সমৃদ্ধি) একটি মানবকেন্দ্রিক কর্মসূচি। ভিক্ষুক পুনর্বাসন সমৃদ্ধির অন্যতম কার্যক্রম। সমৃদ্ধির আওতাভুক্ত দেশের বিভিন্ন উপজেলার ভিক্ষুকদের পূনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ করে পিকেএসএফ। সমৃদ্ধি কার্যক্রমের আওতায় ৮৩৭ জন ভিক্ষুককে এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাদের প্রত্যেককে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার পর্যবেক্ষণে এনে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। এ অনুদানের টাকা দিয়ে সাধারণত গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী, কবুতর কিনে দেয়া হয় এবং এগুলোকে লালন পালনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ওষুধ চিকিৎসা দেয় স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা। ৮৩৭ জন ভিক্ষুকের মধ্যে ৬০০ জনের গড় সম্পত্তি দেড় লাখ টাকা করে।
পিকেএসএফ এর সভাপতি কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মূল স্রোতে আনার জন্য সরকার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই সমৃদ্ধি কার্যক্রম গ্রহণ পিকেএসএফের। এর মধ্যে অন্যতম হল ভিক্ষুকদের স্বাবলম্বী করা। এই উদ্যোগে বেশ সফলতা পাওয়া গেছে।
এমএ/ওআর