ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

যোদ্ধার স্মৃতিতে ৭১

মাসুদ রানা | প্রকাশিত: ০৪:২৬ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

আমাদের বিজয় বহু জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের ত্যাগের স্মৃতিতে অম্লান। ত্যাগ ছুঁয়ে যেসব আলোকিত মানুষের হাত ধরে স্বাধীনতা এসেছে, তাদের অনেকেই এখনও আছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলা ভাঙার দিনগুলো মনে করে এখনও অন্যরকম দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন সেই যোদ্ধারা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনার দিনগুলোর খণ্ড খণ্ড স্মৃতি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আফাজ উদ্দিন ও বাবুল আজাদ।

রাজাকার ও পাক সেনাদের অস্ত্র কেড়ে যুদ্ধ করেছি : বাবুল আজাদ
১৯৭১ সালে গাজীপুরের গোশিঙ্গা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আফাজ উদ্দিন। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে দল বেঁধে ট্রেনে চড়ে রেসকোর্স ময়দানে আসেন। দেশের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকলে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

একাত্তরের সেই স্মৃতি আফাজ উদ্দিনের জবানিতেই শুনুন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গোশিঙ্গা স্কুলের পৌরনীতির শিক্ষক নূর মো. ফকিরের নেতৃত্বে অষ্টম-নবম-দশম মিলিয়ে ২০ থেকে ৩০ জন ঠিক করি ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাব। কোন এক বুধবার যাওয়ার দিন ঠিক হয়। কিন্তু এ খবর মুরব্বিদের কানে গেলে ভেস্তে যায় সব পরিকল্পনা।

আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। একদিন আমার বড় ভাই ইদ্রিস বরমী বাজার থেকে ফেরার পথে তার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ি। আগরতলা পূর্ব দিকে তাই সোজা পূর্ব দিকে যেতে থাকি। একদিন একরাত পর বেলাবোর দিকে পৌঁছাই। ভাগ্যক্রমে এক হিন্দু পরিবারের দেখা পাই, যারা ভারতে যাচ্ছিল। রাতের আঁধারে তাদের সঙ্গে নৌকায় যতদূর মনে পড়ে ভারতের ময়তাপাড়া নামক স্থানে নামি।

গিয়ে উঠি আগরতলার হাপানিয়া ক্যাম্পে। এ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল সফিরউদ্দিন, তার বাড়ি আমার এলাকায়। এ ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য লোক নিত। আমি কয়েকবার দাঁড়িয়েছি, নেয়নি। শেষে সিলেক্ট হলাম। বাগমারায় প্রশিক্ষণ নিলাম দুই মাসের মতো। এলএমজি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি, মার্ক ফোর, থার্টি সিক্স এইচ গ্রেনেড, মর্টার চলনার অভূতপূর্ব প্রশিক্ষণ পেলাম। এবার দেশে প্রবেশের পালা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কসবা এলাকা দিয়ে প্রবেশ করা সহজ ছিল। দেশে প্রবেশের জন্য এখানে কিছু লোক অর্থের বিনিময়ে তথ্য দেয়ার কাজ করত। আমরা দুই-তিনদিন চেষ্টা করেও ঢুকতে পারিনি। একরাতে সিলেটের দিকে রাস্তা দিয়ে লাইন দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম দুই দিক থেকে কারা আমাদের অস্ত্র টেনে নিচ্ছে। কোন গোলাগুলির শব্দ নেই। আমরা বুঝলাম ফাঁদে পড়েছি। সবাই পালাতে থাকলাম। শুরু হলো গোলাগুলি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেল। অনেকে ভারতের দিকে ফিরে গেল, আমি ফিরিনি। আমি ক্রলিং করে এগোচ্ছি, শুনি পাশেই কেউ গোঙ্গাচ্ছে। গিয়ে দেখি আমার বাড়ির পশ্চিম পাশের বাড়ির হযরত আলী। তার পেটে গুলি লেগেছে। এ অবস্থায় তাকে ফেলেও যেতে পারছি না। তাকে বয়ে নিয়ে গেলাম।

একটু নিরাপদে গিয়ে একটা বাড়ি পেলাম। বাড়িতে চারটি ঘর। কোন ঘরে কেউ নেই। এক ঘরে কেবল একজন থুড়থুড়ে বুড়ি। বুড়ির কাছেই হযরত আলীতে রেখে আমি চলে গেলাম। মনে করেছি হয়তো মরে যাবে, বুড়ি হয়তো লাশ দাফনের কোন ব্যবস্থা করবে। পরে শুনেছি সে মরে নাই, বুড়ি তাকে সেবা- শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছিল। কিছুদিন আগে হযরত আলী মারা যায়। মরার আগ পর্যন্ত তার পেটের এক পাশে আঙ্গুল প্রবেশ করানোর মতো গুলির সেই ফুটোটা ছিল।

হযরত আলীকে রেখে নদীর পাড়ে এসে দেখি কোন নৌকাও নেই। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে কলাগাছ কেটে তা দিয়ে নদী পার হই। নদীর এপার আসতে আসতে সকাল হয়ে গেল। এপারে এসে দেখি আমার মতো আরও অনেকে আসতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এক বাড়িতে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে একদিন অবস্থান করি, যাতে আমাদের অবস্থানের বিষয়ে কোন তথ্য পাক-বাহিনী বা রাজাকারদের কাছে না যায়।

পরের রাতে রওয়া দিয়ে চলে আসি এলাকায়। রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টের আশপাশ ছিল আমার দায়িত্বে। একদিন ক্যান্টনমেন্টের উত্তর পাশে ইজ্জতপুর ব্রিজের কাছে অপারেশনের জন্য আমরা প্রস্তুত হই। এজন্য পাশের জসিম উদ্দিন সিরাজীর বাড়িতে অবস্থানে নিই। সেখানে আমাদের খাসি জবেহ করে খাওয়ানো হয়। ৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এখানে আমার বন্ধু শাহবুদ্দিন মারা যায়। শাহবুদ্দিন ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এটাই ছিল তার প্রথম যুদ্ধ। শেষের দিকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে মাথায় গুলি লাগে শাহবুদ্দিনের। পাকবাহিনী তার লাশ ব্রিজের নিচে কাদার মধ্যে পুঁতে রাখে। পরে আমি কয়েকদিন পর কাদা থেকে সেই লাশ তুলে কেরোসিন দিয়ে ধুয়ে গোসল করিয়ে গোশিঙ্গা স্কুল মাঠে দাফন করি।

আফাজ উদ্দিন বলেন, প্রশিক্ষণের পর যে অস্ত্র নিয়ে এসেছিলাম যুদ্ধ করার জন্য তা ছিল অপ্রতুল। আমরা মূলত রাজাকারদের অস্ত্র ও পাক সেনাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।

মুক্তিযোদ্ধা আফাজ উদ্দিন এখন পুরান ঢাকার সিক্কাটুলী লেনে (ছাতা মসজিদের কাছে) জামা-কাপড় ইস্ত্রি করেন। তার দুই ছেলে। এক ছেলে আশিকুর রহমানের বয়স ২৭ বছর, আশফাকুর রহমানের বয়স ৭ বছর।

ঢাকায় প্রবেশে যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে : বাবুল আজাদ
মুক্তিযোদ্ধা বাবুল আজাদ বলেন, আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের মেট্রিকের শেষ ব্যাচের ছাত্র। ৭ মার্চ দুটি ট্রাকে করে বন্ধুবান্ধবসহ ফরাশগঞ্জ থেকে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাই। দেশের জন্য টানটা তখনই মনে তৈরি হয়েছিল।

২৫ মার্চের পর পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে থাকলে বন্ধু মতিউর রহমান রিন্টু ও আমি যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। রিন্টু তার মায়ের ১০০ টাকা চুরি করে। আমরা শবে বরাতের রাতে সদরঘাট থেকে চাঁদপুরের স্টিমারে উঠি। চাঁদপুর নেমে লাকসামের ট্রেনে উঠি। এরমধ্যেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যায়। রিন্টুর পানি পিপাসা পেয়েছিল। পানির জন্য একটু এদিক-ওদিক ঘুরছিলাম। দেখা গেল এক স্থানে পাক-আর্মিরা বাঙ্কার খুঁড়ছে। দেখে দু’জনই ভড়কে গেলাম। আমাদের দেখেই এক আর্মি উর্দুতে বলল, পালিয়ে পালিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। আমি খানিকটা উর্দু জানতাম। সাহস নিয়ে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বললাম, স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের ছেড়ে দিল।

সামনে আসতেই এক লোক বলল, ক্যামনে ছাড়া পাইলেন। কিছুক্ষণ আগেও কয়েকজনকে ধরে নিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে মারছে। বুঝলাম অল্পের জন্য বেঁচে গেছি আমরা।

লাকসাম হয়ে বাগমারায় সীমান্ত পার হয়ে কলেজ টিলার মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ক্যাম্পে গেলাম। সেখান থেকে মেলাঘরের লেম্বুচড়া ট্রেনিং ক্যাম্প। প্রথমে সাত দিনের ট্রেনিং নিলাম। এরপর আরও ৭ দিনের কমান্ডো ট্রেনিং। প্রতিজনে একটি স্টেনগান, ১০টি গ্রেনেড কিছু বিস্ফোরকসহ ফিরে আসতে রওনা হলাম। পূর্ব দিক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে আমরা বাধার মুখে পড়ি। পাকবাহিনী ঢাকা ঘিরে ছিল। আশেপাশে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সুযোগ খুঁজছিলাম ঢাকায় প্রবেশের। কয়েক দফা যুদ্ধও হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে। শেষে ঢাকায় প্রবেশ করি। শেষের দিকে আরও কয়েকজনকে ট্রেনিং করানোর জন্য আগরতলা নিয়ে যাই।

১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকায় নিজের এলাকা ফরাশগঞ্জ ফিরে এলাম। হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণা হয় এখানে। পুরান ঢাকায় অবাঙালিরা আমাদের উপর অনেক নির্যাতন করেছে। আমরা সিনা টান করে হাঁটলেও গালি দিত ওরা। এমন নির্যাতনকারী অনেক অবাঙালিকে ধরে রিন্টুদের বাড়ি আনি শাস্তি দেয়ার জন্য। রিন্টুর মা মায়া করে সবাইকে ছেড়ে দেয়। আবারও ধরে আনি। এরই মধ্যে এলাকার তরুণরা আমাদের সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। আমার আগ্নেয়াস্ত্রটি মোটরসাইকেলে করে আমার কাছে পৌঁছে দেয়ার সময় ফরাশগঞ্জের সরদার মাওলা বখসের ছেলে নাসিরউদ্দিন বখস অসতর্কতাবশত গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বিজয়ের আনন্দ পরিণত হয় শোকে। সে কথা মনে পড়লে এখনও মনটা ভারি হয়ে ওঠে।

মুক্তিযোদ্ধা বাবুল আজাদের বাড়ি পুরান ঢাকার বিকে দাস রোডে। এখানে আর থাকেন না। এখন ঠিকানা গেড়েছেন রাজধানীর রামপুরায়। তার এক ছেলে, নাম শোয়েব আজমীর স্টিভ। ছেলে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন।

আরএমএম/ওআর/এমএস