বিজয়ের ৪৬ বছর : উন্নয়নে এসেছে বিশ্বস্বীকৃতি
ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা। সীমাহীন বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় উজ্জীবিত হয়ে নতুন চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে সেই প্রত্যাশা হয়তো পূরণ হয়নি। তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বহুদূর এগিয়েছে দেশ।
বাংলাদেশের এ উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এসেছে বিশ্বস্বীকৃতিও। তবে দেশ গঠনে গণতান্ত্রিক পন্থায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতসহ দুর্নীতি ও অনিয়ম কমিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে না পারলে মুক্তিকামীদের সেই প্রত্যাশা পূরণে বাধা হতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের সময় কেবল অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, আর্থ-সামাজিক নানা সূচকেই অনেক পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় চরম দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আর স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বিদেশি রাষ্ট্রের শোষণমুক্ত বাংলাদেশ বেশ পুষ্ট হয়েছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বহু পথ এগিয়েছে। পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প কোনো প্রকার বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশের গৌরবময় অর্জনের কথা শুনিয়ে যান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অগ্রগতির ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, যারা এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা আজ এ দেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ মনে করছে।
স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে ‘রোল মডেল’ মনে করছে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ। অনেক ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি নজর কেড়েছে বিশ্বসম্প্রদায়ের।
বিজয়ের ৪৬ বছরে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা কোনো অংশেই কম নয়। তবে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি, নীতিনির্ধারকদের দেশপ্রেমের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে প্রত্যাশিত গতি আসেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জিডিপির আকার এখন ২১ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন ৬ শতাংশের বেশি। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। এখন তা কমে নেমেছে অর্ধেকে।
বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস ডাটাবেস ও আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫৮তম অবস্থানে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জিডিপি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির আঙিনায় ১৪ ধাপ উপরে উঠে ৪৪তম স্থানে অবস্থান করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শূন্য হতে শুরু করে বছর বছর ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। প্রথম প্রজন্মের হাতে গড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানে রূপান্তর হচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে।
ঢাবির সাবেক ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে সব সময় একটি ব্যবধান থাকে। একটি পার্থক্য থাকে। আমরা অনেক কিছুই প্রত্যাশা করি, কিন্তু বাস্তবতার কারণে হয়তো সব সময় তা পূরণ করতে পারি না। আমাদের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, যে প্রত্যাশা ও চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই প্রত্যাশা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে রয়েছি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দীর্ঘদিন এ দেশ পরিচালনা করেছে, এতে আমাদের বিরাট একটি ঘাটতির মধ্যে পড়ি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা এ দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ হয়। ২০০১ সালে যখন জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন আমাদের দেশ ফের পেছনের দিকে যেতে থাকে। আবার ২০০৯ থেকে আমরা নতুন করে যাত্রা করি। বিজয়ের ৪৭ বছরে এসে প্রত্যাশা পূরণে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
আরেফিন সিদ্দিক আরো বলেন, সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হচ্ছে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়া। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বাংলাদেশ গড়া। সেই দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আশা করি, যদি এ পথ-পরিক্রমা আমরা ধরে রাখতে পারি, নিশ্চিয়ই একদিন আমরা প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার এতো বছরে আমাদের অর্জন ও সম্ভাবনা অনেক। তবে স্বাধীনতার পর থেকে যে ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল -তা এক সময় স্লো হয়ে যায়। তাই বলবো, এ অর্জন আরো হতে পারতো। আশির দশকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশে।
অর্থনীতির উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। তাই উন্নয়নের পথে সব থেকে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। এছাড়া বিনিয়োগ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক পরিবেশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে ব্যবসাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার এতো বছর পর আমাদের অর্জন অনেক। দেশের রফতানি খাত বিশ্ব বাজারে এখন একটি উজ্জ্বল নাম। এছাড়া দেশের অর্থনীতিকে আরো অগ্রসর করতে সামনে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক পরিকল্পনা করছেন, যা দেশের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। এখন মানুষ আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। সরকারের নীতিগত সহায়তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পেলে দেশ আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
এমএ/আরএস/এমএস