ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

যেভাবে চলে কিন্ডারগার্টেন স্কুল

মুরাদ হুসাইন | প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে যত্রতত্র প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অধিক সংখ্যক স্কুল রয়েছে। প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী এসব স্কুলে লেখাপড়া করছে। তবে সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বেশি।

কেজি স্কুলে প্লে-গ্রুপ থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। ফ্ল্যাট বাড়ির বদ্ধ পরিবেশে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। জাগো নিউজের তিন পর্বের আনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কেজি স্কুলের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

মিরপুর-১ নম্বর ৫১, জনতা হাউজিংয়ে মুনলিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। স্কুল সাইনবোর্ডে লেখা সেমি ইংলিশ মিডিয়াম ও বাংলা মিডিয়াম স্কুল। ভেতর গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ির নিচ তলায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে চলছে স্কুলটি। চারপাশে অন্ধকার এ ফ্ল্যাটে দুই শিফটে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী আছে। স্থানীয় আট গৃহিনী শিক্ষিকা হিসেবে স্কুলটির পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের রেদওয়ান তলবদার নামে এক কর্মকর্তা স্কুলটির মালিক। এটি তার পার্টটাইম বাণিজ্য সেন্টার। প্রতি মাসে এখান থেকে তিনি প্রায় লাখ টাকা আয় করেন। ২০১৪ সালে পাওয়া এক বছরের প্রাথমিকের অনুমোদন দিয়ে চলছে স্কুলটি। মাথাপিছু মাসিক এক হাজার থেকে ১৫০০ টাকা বেতন দেয়া হয় শিক্ষিকাদের। পাশাপাশি শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি আয়ও করেন তারা।

স্কুলের প্রিন্সিপাল পুঁজা দেবীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২০০১ সাল থেকে এ ফ্ল্যাটে পরিচালিত হচ্ছে মুনলিফ স্কুলটি। দুই ব্যাচে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী এখানে পড়ানো হচ্ছে।

সিলেবাস ও বই সংক্রান্ত বিষয়ে স্কুলের প্রিন্সিপাল বলেন, বড় ক্লাসের চাইতে শিশুদের একটু বেশি বই দিয়ে থাকি। আমাদের নির্ধারিত লাইব্রেরি থেকে অভিভাবকরা বই সংগ্রহ করেন। স্কুলের ইউনিফর্মও নির্ধারিত দোকান থেকে তৈরি বাধ্যতামূলক।

jagonews24

বাচ্চাদের এতো বই পড়ানোর যৌক্তিকতা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাচ্চাদের এতো বই পড়ানো ঠিক না। তারা এতো বই পড়তে চায় না। স্কুল মালিকের নির্দেশনা থাকায় আমরা সেটি বাধ্যতামূলক করেছি। প্রতিষ্ঠানের মালিক যেভাবে চাবেন সেভাবে আমাদের চলতে হবে। এছাড়া বদ্ধ ঘরে স্কুল পরিচালনার বিষয়েও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

স্কুলের পাশে থাকেন গৃহিনী শারমীন আক্তার। তিনি এ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মাসিক এক হাজার টাকা চুক্তিতে গত এক বছর ধরে এ স্কুলে তিনি শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করছেন।

কথা হলে তিনি জানান, প্রিন্সিপাল আমার পরিচিত। তিনি আমাকে এখানে চাকরি দিয়েছেন। বাসায় বসে থাকি তাই সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত প্রতিদিন পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নেই। এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করা এ শিক্ষিকা জানান, প্রতিদিন নিয়মিত প্রে-গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের পড়ান। এছাড়া বাড়িতে দুটি ব্যাচে ২০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ান। এতে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো আয় হয় বলেও জানান তিনি।

দীর্ঘদিন পোশাক কারখানায় চাকরির পর ৪৪/৪, পূর্ব ইন্দ্রিরা রোডে নিউ মনিং গ্লোরি স্কুল খুলেছেন চায়না রানী সরকার। চারতলা বাড়ির নিচ তলায় তিন রুমের একটি ফ্লাটে চলে স্কুলটি। এ স্কুলে প্রে-গ্রুপ থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। কোনো অনুমোদন না থাকলেও পাঁচ বছর ধরে চলছে স্কুলটি। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫০ শিক্ষার্থী রয়েছে। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেনি পর্যন্ত আট হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। মাসিক বেতন ৪০০ থেকে এক হাজার টাকা।

স্কুলের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ অন্ধকার ৬০০ বর্গফুটের একটি ফ্লাটে সব সময় আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়। এর মধ্যে ছোট-বড় সব ধরনের ছেলে-মেয়েদের ক্লাস চলছে। স্কুলটিতে মোট আটজন শিক্ষক। তারা সকলেই গৃহিনী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন। তারাই এ স্কুলের শিক্ষক। কোন স্তরের বাচ্চাদের কী পড়াতে হয় তা জানা নেই স্কুল মালিকসহ কোনো শিক্ষিকার। মাসিক ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা মাথাপিছু বেতন পান তারা।

ছাত্র ভর্তির অজুহাতে স্কুল সম্পর্কে জানতে চাইলে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চায়না রানী সরকার বলেন, আমার স্কুলে লেখাপড়ার মান অনেক ভালো। পাশের অনেক স্কুলের চাইতে এ স্কুলে অনেক ভালো পড়ালেখা হয়। এ এলাকার আর পাঁচটা স্কুল ঘুরে দেখেন, সেখানে বাচ্চাদের বসতে দেয়ারও জায়গা নেই। কিন্তু আমার স্কুলে তিনটি রুমে দুই শিফটে ১৫০ বাচ্চা পড়ানো হয়।

তিনি বলেন, বাচ্চাকে ভর্তি করান। দেখবেন সে যেকোনো স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিলেই চান্স পাবে। তাই দেরি না করে দ্রুত আমার স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করান। আমি সব দেখব।

স্কুলের সামনে অপেক্ষারত এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে পোস্টার-ব্যানার দেখে আমার মেয়েকে নার্সারিতে ভর্তি করাই। ভালো লেখাপড়া শিখবে সেই আশায় এখানে দেই। কিন্তু ভর্তি হওয়ার ক’দিন পর মেয়েটা আর স্কুলে আসতে চায় না। প্রতিদিন জোর করে তাকে স্কুলে আনতে হয়। আবার স্কুল শেষ হলে তাকে নিয়ে যাই।

কেন স্কুলে আসতে চায় না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্কুলটা বদ্ধ, ছোট একটা ফ্ল্যাটে এটি পরিচালিত হয়। বাচ্চাদের খেলাধুলার কোনো স্থান নাই। শুধু গাদি গাদি বই, সেগুলো পড়ার ভয়ে মেয়েটা স্কুলে আসতে চায় না। এতো বেশি বইও সে পড়তে চায় না।

jagonews24

শহরের কথিত কেজি স্কুলের শিক্ষার মান ও শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর) বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, প্লে-গ্রুপ, নার্সারি ও কেজি স্তরে শিশুদের খেলার ছলে বই পড়া শেখাতে কেজি স্কুলের উদ্ভাবন। অথচ যত্রতত্র এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ নেই, শিক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে।

তিনি আরও বলেন, শিশুদের মানসিক বিকাশে সুন্দর পরিবেশ ও দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। অথচ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তেমনভাবে গড়ে উঠছে না। এ কারণে শিশুরা স্কুলবিমুখ হচ্ছে। পড়ালেখা কঠিন বিষয়- মনের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হওয়ায় অনেক শিশু অকালে ঝড়ে পড়ছে। বাচ্চাদের জোর করে স্কুলে আনতে হবে- এটি কখনওই হওয়া উচিত নয়। জোর করে শিশুকে শিক্ষা দেয়া যায় না। তাদের কীভাবে পাঠদান করাতে হবে সেজন্য শিক্ষকদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষিত হতে হবে। নতুবা শিশুদের মনোজগতের বিকাশ হবে না, তাদের সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

এ শিক্ষাবিদ বলেন, বর্তমানে আমাদের শিশুদের ভুল পন্থায় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে স্কুলভীতি তৈরি হচ্ছে। অনেক অভিভাবক না বুঝে কিন্ডারগার্টেন নামক এসব স্কুলে ছেলেমেয়েদের জোর করে পড়াচ্ছেন।

কোথায় সন্তান পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন, সেখানকার পরিবেশ শিশুতোষ কি-না, আগে এসব যাচাই-বাছাই করে সন্তানকে স্কুলে ভর্তির পরামর্শ দিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, শিশুদের    জ্ঞান ও আত্মার বিকাশে মুক্ত পরিবেশ দরকার। শহরের কেজি স্কুলগুলো সে পরিবেশ দিতে পারছে না। কখন, কীভাবে শিশুদের পড়াতে হবে- সেখানকার শিক্ষকরা তাও জানেন না।

এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে শিশুরা শুধু মুখস্থবিদ্যা আর নকলবাজ হিসেবে গড়ে উঠছে বলেও মত দেন তিনি।

এমএইচএম/এমএআর/আরআইপি

আরও পড়ুন