কী পড়ানো হয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে?
রাজধানীর অলি-গলি বা পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। একটি কক্ষ বা একটি খুপড়ি ঘরে হরহামেশায় চলছে কেজি নামে কথিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আলো-বাতাসহীন ফ্ল্যাটে দিনের বেলায়ও আলো জ্বালিয়ে স্কুল চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষার নামে ইচ্ছামতো ফি আদায়, শিশুদের হাতে বইয়ের বোঝা দেয়াসহ অযোগ্য আর অল্প বেতনভুক্ত শিক্ষক দিয়ে চলে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের লেখাপড়া।
জাগো নিউজের তিন পর্বের আনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কেজি স্কুলের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
মিরপুর-১ নম্বরে আহমেদ নগরের ৩৬ আহমেদ নগর, কমিশনার রোডে গড়ে উঠেছে রাবেয়া প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাই স্কুল। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ৬০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাটের চারটি কক্ষে প্লে-গ্রুপ থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। তিন শিফটে ৩০০ শিক্ষার্থী আর ১৭ শিক্ষক দিয়ে চলছে এ স্কুল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) থেকে স্কুলটিকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর অনুমতি দেয়া হলেও এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে সেখানে। পার্শ্ববর্তী বশিরউদ্দিন স্কুলের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রেশন করা হয়। গত ১০ বছর ধরে এভাবে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ স্কুলে প্লে-গ্রুপে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোনো বই না থাকলেও এ স্তরের শিশুদের বাংলা, অংক, ইংরেজি, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি ব্যাকরণ, জ্যামিতি, অ্যাকটিভ ইংলিশ, ধর্ম, সাধারণ জ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি, ওয়ার্ড বুক, ড্রয়িং বুকসহ ১৪টি ডায়েরি কিনতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তী ক্লাস নার্সারিতেও ১২টি বই ও ১৫টি ডায়েরি, কেজিতে এনসিটিবির তিনটি বইসহ ১২টি বই পড়ানো হচ্ছে। এভাবে প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়। কর্তৃপক্ষ বাড়তি লাভের জন্য শিক্ষার্থীদের এসব নিম্নমানের বই কিনতে বাধ্য করে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে জানান, ডিগ্রি পাস করে চাকরি না পেয়ে স্কুলটি খুলেছেন তিনি। প্রতিবেশি একাধিক ভাবি ও তার বন্ধুরাই স্কুলের শিক্ষক। এসব শিক্ষককে মাসিক ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা বেতনবাবদ দেয়া হয়। অতিরিক্ত বইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বেশি বই দেখলে বাচ্চারা খুশি হয়। তাই বেশি বেশি বই দিয়ে খেলার ছলে আমরা শিশুদের শিক্ষা দেই।
রাজধানীর একাধিক এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নেই শিক্ষার পরিবেশ। দু-তিনটি কক্ষে ছোটছোট খুপড়ি বানিয়ে চলছে এসব স্কুল। আবার কোথাও একটি কক্ষেই পরিচালিত হচ্ছে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। গাদাগাদি করে পাশাপাশি টেবিলে ক্লাস নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির। এসব স্কুলে সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক নামে একাধিক পরীক্ষার আয়োজন রয়েছে। তবে কোনো ক্লাসেই ঠিকমতো পাঠদান হয় না বলে অভিযোগ।
অভিভাবকদের অভিযোগ, শুধু পরীক্ষার ফি-ই নয়, বেতনের ক্ষেত্রেও কোনো নীতিমালা নেই এসব স্কুলে। এছাড়া বার্ষিক ভর্তি ফিসহ নানা খাত দেখিয়ে বছরে একটি মোটা অংকের অর্থ গুণতে হয় তাদের। কর্তৃপক্ষ এত টাকা নিলেও ক্লাসে সঠিক শিক্ষা পায় না কোমলমতি শিশুরা। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস করাতে না পারলেও ব্যস্ত থাকেন টিউশনিতে। এভাবে মাসের পর মাস অভিভাবকদের গুণতে হয় কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) হিসাবে, সারাদেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। তবে এ স্কুলের বিভিন্ন সংগঠনের হিসাব মতে, সারাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হবে।
রাজধানীর সূত্রাপুরের কাগজিটোলায় প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ বর্গফুটের কক্ষে চলছে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এখানে তিনটি টেবিলে পড়ানো হয় প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের। অন্য তিনটি টেবিলে বসে প্রথম শ্রেণির শিশুরা। অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বসে গাদাগাদি করে। ছোট্ট দুটি ব্ল্যাকবোর্ড রয়েছে। বসার জায়গা নেই শিক্ষকদের। দরজার সামনে বসে থাকেন অভিভাবকরা।
স্কুলে অপেক্ষারত অভিভাবক আয়শা জাহান জানান, বাসায় সারাদিন চার দেয়ালে বন্দি থাকে বাচ্চাটা। স্কুলেও একই অবস্থা। পড়ার ফাঁকে একটু যে দৌড়াদৌড়ি করবে, সে জায়গাটুকুও নেই।
অতিরিক্ত পাঠ্যবই প্রসঙ্গে অভিভাবক অহিদুল ইসলাম বলেন, স্কুল থেকে সন্তানের জন্য যে পড়া দেয়া হয়, তা তৈরি করতে দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়। অনেক চাপের কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় না। তাই আগামী বছর সন্তানকে অন্য স্কুলে দেয়ার চিন্তা করছি। যে ক’টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে খোঁজ নিয়েছি সবগুলোর অবস্থা একই। এখন বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী করণীয়, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হেমায়েত উদ্দিন বাদল জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুলে খেলার ছলে পড়ালেখা করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। বর্তমানে এসব স্কুল মুরগির খামারে পরিণত হয়েছে। ইচ্ছামতো সিলেবাস তৈরি, বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। অন্ধকার ফ্ল্যাট বাড়িতে অদক্ষ শিক্ষক দিয়ে চলে অধিকাংশ স্কুল। সরকারের কোনো নজরদারি না থাকায় প্রতিনিয়ত এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক লাভবান হতে অভিভাবকদের বাড়তি বই কিনতে বাধ্য করছে। বেশি বেশি নোট ও পরীক্ষার আয়োজন করে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সন্তানের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে সকলে এসব মেনে নিচ্ছেন। ফলে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নিবন্ধন পদ্ধতি জটিল হওয়ায় প্রায় সকলেই অবৈধভাবে স্কুল পরিচালনা করছেন। এ কারণে দেশে ৫০ হাজার স্কুল থাকলেও মাত্র ছয় হাজারের মতো বৈধ। নিবন্ধন করতে ৫০ হাজার টাকা জমা দেয়ার কথা থাকলেও সেখানে বাড়তি ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। নতুবা সে ফাইল টেবিল থেকে নড়ে না। আবার ফ্ল্যাট বাড়িতে স্কুল বানিয়ে ইচ্ছামতো চালালেও কারও যেন দেখার নেই। তাই সহজ লাভে বিকল্পপন্থায় চলছে শহরের কেজি স্কুলগুলো।
এমএইচএম/বিএ/এমএআর/আইআই