বাংলাদেশে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঈর্ষণীয়
আজাদুল হক। বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টন শহরে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় একটি এনার্জি কোম্পানির আইটি বিভাগ পরিচালনা করছেন। সাবেক সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা)। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড- ২০১৭ আয়োজিত মেলায় ‘সাইবার সিকিউরিটি’বিষয়ক সেমিনারে মূল বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশের প্রযুক্তির উন্নয়ন, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাইবার নিরাপত্তার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। ‘প্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলাদেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে’ উল্লেখ করে এ প্রযুক্তিবিদ বলেন, এখন সচেতনতার ওপরই অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আশাবাদ ব্যক্ত করেন তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহ নিয়েও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু ও নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত।
জাগো নিউজ : ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলার মাধ্যমে আসলে কী বার্তা দেয়া গেলো?
আজাদুল হক : আমাকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনা হয়েছে মূলত সাইবার সিকিউরিটির ওপর আলোচনা করতে। নতুন প্রজন্মের তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি উৎসাহ দেখে অবাক হয়েছি। এ মেলা আয়োজনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে এখানেই। তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্বটা অন্তত সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে এ মেলার মাধ্যমে।
জাগো নিউজ : সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে বিশেষত কী বার্তা দিলেন?
আজাদুল হক : সাইবার সিকিউরিটি শুধু আইটি সিকিউরিটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত, তা নয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর গুরুত্ব কী, তা নিয়েই আলোচনা হলো। হ্যাকিং করে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হ্যাকাররা। তারা জাতীয় তথ্যও চুরি করে। অথবা চলতি সরকারকে বিপদগ্রস্ত করতেও হ্যাকাররা হ্যাকিং করতে পারে।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি হলো। সাইবার সিকিউরিটিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
আজাদুল হক : আমি সাইবার সিকিউরিটির টেকনিক্যাল বিষয়টি দেখছি না। মূলত সাইবার সিকিউরিটির ব্যবস্থাপনা নিয়েই আমার আলোচনা। সবাই এখন সচেতন হচ্ছেন। আমাদের আলোচনায় পুলিশের একজন ডিআইজি বললেন, আলাদা একটি ফোর্স গঠন করা হবে সাইবার অপরাধ মোকাবেলার জন্য। কিন্তু তার পক্ষ থেকে যে সাইবার অপরাধের কথা বলা হলো, তা থেকে আমাদের সাইবার আলোচনা ভিন্ন।
জাগো নিউজ : আলাদা কেন বলছেন? যদি ব্যাখা করতেন...
আজাদুল হক : একটি চুরি আর একটি খুনের অপরাধের মধ্যে পার্থক্য আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের নিরাপত্তার জন্য সাইবার অপরাধগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। কাউকে অনলাইনে হুমকি দিলে, পুলিশ তা ট্র্যাকিং করে অপরাধী খোঁজেন। আর আমাদের পর্যবেক্ষণের পরিসর আরও বড়। একটি জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কোনো বিষয়ে প্রভাবিত করার অপরাধ আর চুরির অপরাধ এক বিষয় নয়। রাশিয়ার হ্যাকাররা এবার আমেরিকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করলো। আমেরিকার নির্বাচনে কালি দিতে পেরেছে। আমেরিকা কিন্তু ইমেজ সংকটে পড়েছে এ নিয়ে।
জাগো নিউজ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরিতে এমন ইমেজ সংকটে তো বাংলাদেশও?
আজাদুল হক : হ্যাঁ। টাকা কী পরিমাণ খোয়া গেছে সেটা বড় কথা নয়, আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি যাওয়ায়, সেটাই বড় কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করলেন। এরকম অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা পদত্যাগ করছেন, নতুবা চাকরি চলে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে বলছেন, আমি টেকনিক্যাল বিষয়ে জানি না। এ সময়ে এমন দায় এড়ানো যাবে না। নির্বাহীর নেতৃত্বে থাকলে দায় তো নিতেই হবে।
জাগো নিউজ : একজন নেতার সাইবারের ওপর ধারণা না থাকতেই পারে?
আজাদুল হক : এখানেই ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জানতে পারতেন। প্রক্রিয়ার সঠিক প্রয়োগ না থাকলে জানার উপায় থাকে না।
জাগো নিউজ : এ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হয়। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কী বলবেন?
আজাদুল হক : আমাদের ব্যবস্থাপনা একেবারে নাজুক অবস্থায়, তা মনে করছি না। আমাদের থ্রেটটা এখনও সেই লেভেলে আসেনি। তবে বাংলাদেশ অচিরেই মধ্য আয়ের দেশে যাচ্ছে এবং ধাক্কা তখনই আসতে পারে। সাইবার সিকিউরিটি বাড়াতে প্রস্তুতি দরকার এখনই।
জাগো নিউজ : আপনার পরামর্শ কী?
আজাদুল হক : আমি চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছি। কেন্দ্রীয়ভাবে সংকেত ব্যবস্থা রাখতে হবে ব্যাংকগুলোর জন্য। এটি বাধ্যতামূলক। থ্রেট আসা মাত্রই সবার কাছে সংকেত চলে যাবে। কিছুদিন আগে একটি ভাইরাস নিয়ে গোটা পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। এক ঘণ্টার মধ্যে সার্ভারে ধস নামাতে পারতো। ওই ভাইরাস ঠেকাতে সার্ভার শাটডাউন দিতে হতো। একবার শাটডাউন দিলে তো সব যোগাযোগ থেকে আপাতত বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। এটি হলে বড় ক্ষতি সবার জন্যই।
জাগো নিউজ : এ প্রশ্নে আপনার অবস্থান থেকে কী মনে করছেন?
আজাদুল হক : বাংলাদেশ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঈর্ষণীয়। অন্যরা আগামী ২০ বছরে যা করবে আমরা তা দুই বছরে করতে পারবো। এ কারণে আমাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এসেছে। মন্ত্রী বললেন, আগামীতে এক লাখ এক্সপার্ট নিয়োগ দেবেন। ভালো কথা। কিন্তু যদি বলা হয়, আগামী এক বছরের মধ্যে এক হাজার এক্সপার্ট তৈরি করা হবে, তা সম্ভব না। সময়ের ব্যাপার। চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে এক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা যায় না।
জাগো নিউজ : তাহলে আশাবাদী হচ্ছেন কীসে?
আজাদুল হক : এক লাখ এক্সপার্টের কথা মন্ত্রী হয়তো সামগ্রিকভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। সবপর্যায়ে একই মানের এক্সপার্ট দরকার আছে বলে মনে করি না। ইউনিয়ন পরিষদে একজন এক্সপার্ট এবং পলিসি লেভেলের এক্সপার্ট এক বিষয় না। আমরা আশাবাদী সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং তরুণরা এতে সায় দিচ্ছে।
জাগো নিউজ : ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানটিও তো এক্ষেত্রে সহায়ক হলো?
আজাদুল হক : অবশ্যই। গ্রামের একজন তরুণ যুবকও এ স্লোগান বুকে ধারণ করে প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি কম্পিউটার কিনে গ্রামেই ওই যুবক প্রযুক্তিসেবা দিতে পারছেন। মানুষ তো সরকারের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। আবার সরকারও মানুষের আবেগ-চাহিদা বুঝে উদ্যোগ নিচ্ছে।
জাগো নিউজ : প্রযুক্তির বাতাবরণে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। এরপরও প্রশ্ন- সাইবার অপরাধে পৃথিবী আরো অনিরাপদ হচ্ছে কি?
আজাদুল হক : অনিরাপদ না বললেও নিরাপত্তা ঝুঁকি যে বেড়ে গেছে, তা বলা যেতে পারে। যেমন মানুষের সম্পদ কিন্তু অদৃশ্য এখন। ভিজুয়াল থাকছে না টাকা। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকার কাজ সারা হচ্ছে। তথ্যই এখন অর্থ। তথ্য চুরি হওয়া মানে টাকাও চুরি হওয়া। টাকা চুরি হলে পুলিশ চেষ্টা করে ফিজিক্যালি উদ্ধার করতে পারে। কিন্ত তথ্য ঘুরছে বাতাসে। তা উদ্ধার করা অনেক কঠিন বটে। একজন হ্যাকার কীভাবে তথ্য চুরি করেন, তাই আলোচনা করেছি এবারের সেমিনারে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশের টাকা কি ফেরত পাওয়া যাবে? আমি বলেছি, না। কারণ অনেক কঠিন হবে এ টাকা উদ্ধারে। চুরি হওয়া অর্থ পুরোটি উদ্ধার করতে গিয়ে সেই পরিমাণ টাকা ব্যয়ও হয়ে যেতে পারে। একটি পানিভর্তি ড্রামে সামান্য চিনির মিশ্রণ করলে সে চিনি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সাইবার অপরাধ ঠিক তেমনই।
জাগো নিউজ : এ অপরাধচক্র ঠেকাতে তো প্রযুক্তির উন্নয়নও ঘটছে…
আজাদুল হক : হ্যাঁ। নতুন নতুন সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে। কিন্তু আমি মনে করি মানসিক পরিবর্তন না হলে আপনি এ অপরাধ ঠেকাতে পারবেন না।
জাগো নিউজ : এখানে মানসিক পরিবর্তন বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
আজাদুল হক : সাইবার হাইজিন কালচার তৈরি করতে হবে। সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। যেন-তেন বা নকল সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না।
বিমানবন্দরে গিয়ে আপনার ব্যাগ আপনি যদি প্যাক না করেন, অন্য কেউ করে দেবে না। আপনার ডিভাইস আপনারই। এর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও আপনার। সচেতন হওয়ার বিষয়টি আসে। পুলিশ দিয়ে আপনি এটি রক্ষা করতে পারবেন না। সামান্য একটি পেনড্রাইভ দিয়ে আপনার সমস্ত কিছু চুরি হয়ে যেতে পারে। আপনি নিউজ সাইট পড়ছেন, অনেক বিজ্ঞাপন আসছে অযথা। সেখানে ক্লিক করার দরকার নেই। এগুলো সব ভাইরাস।
আপনি অফিসের কম্পিউটারে বসে কোথায় ক্লিক করছেন, তার সবই জমা হচ্ছে। কেউ নিয়ন্ত্রণ করছেন, তা নয়। কিন্তু জমা হচ্ছে কোথাও। আপনি অফিসে বসে নাটক বা ফেসবুক ব্যবহার করবেন কেন? আপনি তো অফিসকে ফাঁকি দিচ্ছেন। সরকারের অর্থ অপচয় করছেন। তা কেন? এ সচেতনতাই হচ্ছে সাইবার হাইজিন কালচার।
জাগো নিউজ : এ কালচার তৈরিতে অগ্রগতি দেখছেন?
আজাদুল হক : হ্যাঁ। খুবই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলো। দশ বছর আগের বন্ধুত্বের ধারণা আর এখনকার ধারণা ভিন্ন। দেখা নাই, তবুও ফেসবুকে বন্ধু। ভালো-মন্দ সে ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু পরিবর্তন আসছে সেটা তো অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।
জাগো নিউজ : সার্বিক বিচারে আপনি বাংলাদেশের প্রযুক্তির উন্নয়ন আশাবাদী বটে...
আজাদুল হক : ভীষণভাবে আশাবাদী আমি। অন্য দেশেও তো দেখছি। বাংলাদেশের মতো প্রযুক্তির উন্নয়ন পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখিনি। বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে প্রযুক্তি বিষয়ে যতো কাছে যাওয়া যায়, অন্য দেশের সরকারের বেলায় তা হয় না।
প্রযুক্তির উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতা-ই বিপ্লব ঘটাবে। ব্রেন ড্রেইনের (মেধা পাচার) মাধ্যমে যে মেধা বাইরে চলে গেছে, সরকার সে মেধা ফেরত আনতে সচেষ্ট বলে মনে করি। সবকিছু্ই সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে চাই। সবাইকে নিয়েই আমাদের সে প্রয়াস থাকবে।
এএসএস/এএস/বিএ/এমএআর/আরআইপি