তরুণদের মাঠে নামাতে পারছেন না খালেদা
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের পর থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। ওই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাবেক ছাত্রদল নেতাদের প্রাধান্য দিয়েই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তাতেও হালে পানি পাচ্ছে না বিএনপি। আলোচিত ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও রাজপথে দেখা নেই ওই নেতাদের। এই অবস্থায় হতাশাতেই হাবুডুবু খাচ্ছে বিএনপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক নেতা জানান, বার্ধক্যজনিত কারণে জ্যেষ্ঠ নেতারা মাঠে নামতে না পারলেও আশা ছিল তরুণরা সাহস নিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে কর্মসূচি সফল করবেন। এসব তরুণ নেতৃত্ব থেকেই সাহসী শতাধিক নূর হোসেন বেরিয়ে আসবে। তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের সেই আশায়ও গুড়েবালি।
গত বছর ৫০২ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে তরুণ অনেক নেতাকেই বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে বিএনপিতে পদায়ন করা হয়। সরাসরি মূল দলে স্থান পাওয়া এসব নেতাদের নিয়ে অন্যরকম স্বপ্ন ছিল খালেদা জিয়ার।
উদীয়মান নেতাদের উদ্দীপনা ও তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে দলকে আরও গতিশীল করার চিন্তা ছিল বিএনপি নেত্রীর। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণার পর তরুণ নেতাদের ‘সেফ জোন পলিটিক্স’ কৌশলের কারণে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
দলীয় সূত্র জানায়, তরুণ অনেক নেতাই আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পছন্দের আসন চষে বেড়াচ্ছেন। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘামও ঝরাচ্ছেন। নানাভাবে হাইকমান্ডের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তবে যখনই কেন্দ্র থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তখনই তারা দৃশ্যপটের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ বিএনপির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয় দলটি। কর্মসূচি সফল করতে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে ঝটিকা মিছিল করে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা। তবে ঢাকায় অবস্থানরত বিএনপিতে পদ পাওয়া তরুণ কোনো নেতাকে এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি। এমনকি, বেশিরভাগ বিভাগীয় ও জেলা শহরেও তাদের নেতৃত্বে কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজপথে নামার খবর পাওয়া যায়নি।
তবে কর্মসূচিতে অংশ না নিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ তৎপর রয়েছেন অনেকে। সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা, দলের পক্ষে প্রচারণা; এমনকি, আত্মপ্রচারণাও অব্যাহত রেখেছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ মাঠে নামতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন; বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সহ সম্পাদক। খোকন বলেন- কীসের ভয়ে, কী জন্য তরুণ নেতারা মাঠে নামছেন না জানি না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে থিম, আগামী দিনে নির্বাচন বা দেশ পরিচালনার ধ্যান-ধারণা। এমন বাস্তবতায় আন্দোলনের যে ডাক, তা জোরালোভাবে না আসলে দিক- নির্দেশনা না থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি মনে করেন, একেবারেই শক্তি সঞ্চয় করে এখনই মাঠে নামা উচিত। সময় এখন মাঠে নামার। যদি না নামি তাহলে আমরা ভুল করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমার মনে হয় আরও দায়িত্বশীল যারা আছেন, যারা একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করেছেন। এরকম অসংখ্য নেতারা আছেন। আমি যদি নামই বলে দেই- আমান উল্লাহ আমান আছেন, খায়রুল কবির খোকন আছেন, ফজলুল হক মিলন আছেন, নাজিম উদ্দিন আলম আছেন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী আছেন, সাইফুল আলম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, শফিউল বারী বাবু এদের জিজ্ঞাসা করেন। তাদের জিজ্ঞাসা করলে ভালো হয়।
তিনি বলেন, এ নিয়ে আমার মনে অনেক ক্ষোভ, অনেক দুঃখ ও কষ্ট। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নানা কারণে পারিনি। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করছি।
সাবেক ছাত্রনেতা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম বলেন, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা চলছে, যে স্বৈরশাসন চলছে এখানে তো রাজনৈতিক চর্চা করা দুরূহ ব্যাপার। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করাও দুরূহ ব্যাপার। বাকশালের চেয়েও এখন খারাপ অবস্থা। এমন বাস্তবতায় কাকে দোষারোপ করব?
মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না হয়ে যারা বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির চর্চা করছেন তাদের সমালোচনা করে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি করার অনেক সিনিয়র নেতা আমাদের রয়েছেন। সবই লাগবে। মাঠ গরম করতে হবে। মাঠ গরম করা ছাড়া কোনো দাবি অতীতে আদায় হয়নি, হবেও না।
তিনি মনে করেন, এখন সময়ের দাবি, জনগণের দাবি আন্দোলন করার। আন্দোলন ছাড়া কেউ কোনো দাবি আদায় করতে পারেনি। কেউ আপনাকে এমনি সাইড দিয়ে কিছু দেবে না। যে যেভাবে পারে সে সেভাবেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। ভবিষ্যতেও টিকে থাকতে চাইবে। যেসব অনিয়ম হচ্ছে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের অনেক ক্ষোভ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নাই। আন্দোলনে নামতে হবে।
এ বিষয়ে দলের মুখপাত্র যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ৯০ দশকে রাজপথ কাঁপানো আলোচিত নেতাদের অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান।
জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রনেতা ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। ৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, ৯০ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সর্বশেষ ৯৬ সালে প্রশাসনিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। সবসময় একরকম মুভমেন্ট হয় না।
তিনি বলেন, আমরা নয় বছর ধরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছি। এরশাদকে বিদায় নিতেই হয়েছে। বর্তমান সরকারও বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল করে আছে। তাদেরকেও বিদায় নিতেই হবে। তরুণরা অপেক্ষায় আছে। তারা সুযোগ পেলেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বিএনপির বর্তমান কমিটিতে তরুণ প্রজন্মের আরেক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সামনে আমাদের আন্দোলনের যে বিষয়টি আসছে, মূলত এখন তা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য ম্যাডাম নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করছেন।
রাজনৈতিক দলে সুবিধাবাদী কিছু নেতা সবসময় থাকে এমন মতামত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যারা কর্মসূচির ঘোষণা করার পর দৃশ্যপটের বাইরে চলে যান অথচ আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন, তাদের নিয়ে শীর্ষ নেতাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আবার যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সারা বছর মাঠে থাকার চেষ্টা করছেন আগামীতে সুযোগ আসলে তাদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে পুরষ্কৃত করা হবে, এমন আলাপও দলের হাইকমান্ডের মধ্যে হচ্ছে।
এসব বিষয়ে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, লাখো শহীদের রক্তস্নাত এই সংগঠনের যেকোনো পদকে পবিত্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করে সবারই দলের সব রাজনৈতিক কাজে থাকা উচিত। যারা কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন, ভালো কাজ করছেন। আর যারা অংশগ্রহণ করছেন না, আশা করি শিগগিরই দলের সব কাজে অংশগ্রহণ করবেন।
এমএম/এসআর/আইআই