দুরবস্থায় আর্থিক খাত
চড়া সুদ দিয়েও একাধিক অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত পাচ্ছে না। ফলে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। মুনাফারও দেখা পাচ্ছে না বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। লোকসানের সঙ্গে সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। আমানত, তারল্য, মুনাফা ও সম্পদ মূল্য নিয়ে এক প্রকার দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে দেশের বেশকিছু অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠনগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫টি মুনাফার দেখা পায়নি। কোম্পানিগুলো বড় অঙ্কের লোকসানে রয়েছে।
আর শেষ তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) হিসাবে ৬টি প্রতিষ্ঠান লোকসানে রয়েছে। অপরদিকে নয় মাসের হিসাবে পরিচালন নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে ৪টি। আর একটি কোম্পানির সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫টির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত না পাওয়ায় প্রতিনিয়ত কলমানি মার্কেটে (আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার) ধরনা দিচ্ছে অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মূলত ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অর্থ ধার করে চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। তারল্য সংকটের কারণে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। অনেক গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে আমানত ফেরত চাইলে চুক্তির চেয়ে বেশি মুনাফা দেয়ার কথা বলে তিন-চার মাস সময় নিচ্ছেন।
আমানত সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তাদের মতে, অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত রাখতে খুব একটা আগ্রহী না গ্রাহকরা। এ পরিস্থিতিতে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ কোম্পানিকে কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
এ দিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল মোটা অঙ্কের লোকসানে রয়েছে।
এর মধ্যে সব থেকে বেশি লোকসানে রয়েছে বিআইএফসি। চলতি বছরের নয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। আর শেষ তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লোকসান হয়েছে ২ টাকা। আগের বছরেও প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৬ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে বিআইএফসি শেয়ারপ্রতি লোকসান করে ৪ টাকা ৯০ পয়সা।
লোকসানের পাশাপাশি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ মূল্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ কোম্পানির সকল সম্পদ বিক্রি করে দিলেও পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ হবে না। অর্থাৎ পাওনাদারের টাকা ফেরত পাওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিআইএফসির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ টাকা ৩০ পয়সা। অথচ এক বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ৫ টাকা ২ পয়সা।
লোকসানের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফারইস্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫ টাকা ১০ পয়সা। আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। এর পরেই রয়েছে প্রাইম ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান রয়েছে ৩ টাকা ৩৬ পয়সা। আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২ টাকা ৯৭ পয়সা।
এ ছাড়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল চলতি বছরের নয় মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ২ টাকা ১৮ পয়সা। তবে আগের বছর প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি ৪৪ পয়সা মুনাফায় ছিল। চলতি বছরে লোকসানের পাশাপাশি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থ সংকটও দেখা দিয়েছে। জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ টাকা ১৮ পয়সা। অপর প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১ টাকা ১৯ পয়সা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৩০ পয়সা।
ইউনিয়ন ক্যাপিটালের পাশাপাশি নগদ অর্থ সংকটে পড়ার তালিকায় রয়েছে- লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, আইপিডিসি ফাইন্যান্স এবং জিএসপি ফাইন্যান্স। এর মধ্যে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ৬ টাকা ১৫ পয়সা, আইপিডিসি ফাইন্যান্স ১ টাকা ৯৪ পয়সা ও জিএসপি ফাইন্যান্স ৭০ পয়সা শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।
মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে- ইসলামীক ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, আইপিডিসি ফাইন্যান্স এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
তালিকাভুক্ত লিজিং কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র
ব্যাংকের নাম |
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়) |
শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়) |
শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (টাকায়) |
শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল (টাকায়) |
||||
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৭ |
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৬ |
জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭ |
জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬ |
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৭ |
জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৬ |
৩০ সেপ্টেম্বর-২০১৭ |
৩০ সেপ্টেম্বর-২০১৬ |
|
বে লিজিং |
০.৯৯ |
০.৮০ |
০.৩৪ |
০.২৯ |
১.০৩ |
০.৮৭ |
১৯.৬৮ |
২০.১৯ |
বিডি ফাইন্যান্স |
০.৫১ |
(০.৩৫) |
(০.০৪) |
(০.৮০) |
৮.৭৩ |
(২.৪৮) |
১৪.৯১ |
১৫.৯৪ |
বিআইএফসি |
(৫.৪৫) |
(৪.৯০) |
(২.০০) |
(১.৫১) |
১.৬৪ |
৩.৪৫ |
(২.৩০) |
৫.০২ |
ডিবিএইচ |
৬.৫৯ |
৫.৭৩ |
১.৮৩ |
১.৬৫ |
২৮.৯৪ |
২৫.২৩ |
৩৪.৫৬ |
৩১.২৬ |
ফারইস্ট ফাইন্যান্স |
(৫.১০) |
(০.৭৫) |
(০.৬৭) |
০.৬৩ |
০.০১ |
২.২৫ |
৬.৯৮ |
১২.৫৮ |
ফাস ফাইন্যান্স |
০.৭০ |
০.২৭ |
০.০৮ |
০.৪০ |
৬.০০ |
১০.১০ |
১৪.২৭ |
১৪.১২ |
ফার্স্ট ফাইন্যান্স |
(১.১৯) |
(১.৩০) |
(০.৭২) |
০.২৫ |
৫.৯২ |
২.৪১ |
১২.৩১ |
১১.৭৭ |
জিএসপি ফাইন্যান্স |
২.০৩ |
১.৩২ |
০.৭১ |
০.৩৯ |
(০.৭০) |
(০.৭৯) |
২৪.১৯ |
২৪.৩৬ |
আইসিবি |
৫.৬৭ |
১.৬০ |
৩.৩৮ |
০.০৮ |
৩৬.২২ |
২২.৭০ |
৮২.০৭ |
৫৪.৭৪ |
আইডিএলসি |
৪.৯০ |
৪.১৪ |
১.৭৩ |
১.৪২ |
২৩.০৮ |
(৫.৭৬) |
৩২.১৭ |
২৩.৭০ |
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং |
০.৫৪ |
(০.১৯) |
১.২৭ |
(০.০২) |
৩.২৪ |
(১৬.৭১) |
১২.৮৫ |
১২.৩১ |
আইপিডিসি |
১.২১ |
১.৪০ |
০.৪৮ |
০.৪১ |
(১.৯৪) |
০.৫৩ |
১৬.৪৭ |
১৫.২৬ |
ইসলামীক ফাইন্যান্স |
০.৮৩৮ |
০.৮৪৪ |
০.১০৫ |
০.২৮০ |
৪.১৮ |
৮.৭৭ |
১৩.৩১ |
১১.৭০ |
লংকাবাংলা |
৩.৩১ |
১.০৩ |
১.৩১ |
০.১৬ |
(৬.১৫) |
(১.১৫) |
২৩.০১ |
২১.০১ |
মাইডাস ফাইন্যান্স |
১.৩৫ |
১.৫০ |
০.৩৭ |
০.৩৮ |
০.৬৭ |
২.১১ |
১১.৬২ |
৯.৬০ |
ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স |
১.৬৭ |
১.৭১ |
০.৪২ |
০.৪০ |
১৮.২১ |
৪.৩৮ |
১৫.২৬ |
১৫.৩৯ |
ফনিক্স ফাইন্যান্স |
১.৬৯ |
১.৬৪ |
০.৪৫ |
০.৫৫ |
১.৬১ |
১.৪৮ |
২০.৭৬ |
২১.০৮ |
পিপলস লিজিং |
০.৪২ |
(২.৪৭) |
০.১৬ |
(১.৩২) |
২.৭৪ |
(৭.২৯) |
১১.৩১ |
১০.১৬ |
প্রিমিয়ার লিজিং |
০.৭১ |
০.৪৬ |
০.২২ |
০.১১ |
৬.৫৭ |
(২.০২) |
১২.২০ |
১২.০৭ |
প্রাইম ফাইন্যান্স |
(৩.৩৬) |
(২.৯৭) |
(১.৯২) |
(০.৭৭) |
২.৬৪ |
(২.৬৪) |
৬.৮৪ |
১০.২১ |
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল |
(২.১৮) |
০.৪৪ |
(০.৮৫) |
০.২১ |
(২.১৮) |
(১.৫৮) |
১৩.৩৬ |
১৬.১৮ |
ইউনাইটেড ফাইন্যান্স |
১.০১ |
১.১৯ |
০.৩৩ |
০.৩৩ |
২.২৫ |
(৩.০২) |
১৬.৫২ |
১৬.৪৭ |
উত্তরা ফাইন্যান্স |
৭.৮৭ |
৬.৭৩ |
২.২৯ |
১.৫২ |
১২.৩৭ |
২৪.৮০ |
৫০.৩৬ |
৪৫.৪৯ |
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান ৭ শতাংশ সুদেই প্রচুর আমানত পাচ্ছে। কিন্তু অনেকে ১০ শতাংশের প্রস্তাব দিয়েও আমানত পাচ্ছে না। কারণে ওদের ইমেজ সংকট আছে।
তিনি বলেন, যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান করছে তাদের কস্ট অফ ফান্ড বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে এখন আমাদের সবাইকে সিঙ্গেল ডিজিটে লেন্ডিং করতে হচ্ছে। স্প্রেড চার শতাংশের মধ্যে থাকবে হবে। সে কারণে আমাদের লভ্যাংশ কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো এগ্রেসিফ ফাইন্যান্স করছে। ব্যাংকগুলো সাড়ে আট, নয় শতাংশ সুদে ফাইন্যান্স (ঋণ দেয়া) করছে। এখন ১৩ শতাংশে সুদে কেউ ঋণ নেবে না।
বিআইএফসি’র বিষয়ে তিনি বলেন, গত এক বছর ধরেই এ প্রতিষ্ঠানটি সমস্যা করছে। তারা নতুন করে লেন্ডিং (ঋণ দেয়া) করছে না। তাদের ওখানে কেউ ডিপোজিট রাখে না। যে কারণে লোকসানের পাশপাশি প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলো আমানত নিয়ে বসে থাকবে না, তাদেরকে ঋণ দিতে হবে। এখন তাদের ঋণ বিতরণের চিত্রটা কি সেটা দেখতে হবে। আর আমনতকারীদের আস্থা না পেলে লিজিং কোম্পানিগুলো আমানত পবে না।
তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো কোথায় ঋণ দিচ্ছে, সেই ঋণ সময় মতো পরিশোধ হচ্ছে কি না বা সুদ ঠিকমত পরিশোধন হচ্ছে কি না, তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি কোন কোম্পানি ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য অ্যাকাউন্ট ম্যানুপুলেট করছে কি না এসব বিষয়গুলো ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।
এমএএস/আরএএস/এমএস