পারিবারিক কলহে প্রাণহানি বাড়ছে
রাজধানীর কাকরাইলে মা ও ছেলে এবং উত্তর বাড্ডায় বাবা ও মেয়েকে হত্যার প্রাথমিক কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ‘পারিবারিক কলহ’। স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের একে-অপরের সঙ্গে কলহ-দ্বন্দ্ব আদিম যুগ থেকেই বাংলাদেশে ছিল। তবে বর্তমানে তা ভয়ঙ্ককর রূপ ধারণ করেছে। শুধু গত ১০ মাসে এই কলহের জেরে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৫১৩ জন। তাদের মধ্যে কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, কেউ আত্মহত্যা করেছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পারিবারিক কলহের জেরে মারা গেছেন ৩৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১২৮ জন। ২০১৬ সালে একই কারণে প্রাণ যায় ৩৮৪ জনের এবং আহত হন ৩১৩ জন। ২০১৫ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯ এবং আহত ৩২৭জন।
গত বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে ব্যবসায়ী আবদুল করিমের স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছেলে শাওনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহতের আত্মীয়-স্বজন ও দীর্ঘদিন ধরে ওই বাড়িতে থাকা ভাড়াটিয়ারা দাবি করছেন, বাড়ির মালিক আবদুল করিমের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে সৃষ্ট কলহের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
ওইদিন একই সময়ে মুন্সীগঞ্জে মো. মমিন (৫০), স্ত্রী লুবনা বেগম (৪৪) ও শিশুকন্যা সানজিদা (৯) একসঙ্গে বিষপানে ‘আত্মহত্যা’ করেন। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বাড্ডায় হত্যা করা হয় বাবা ও মেয়েকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ধারণা, ওই তিন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে পারিবারিক কলহ। বিএমবিএসের ওই পরিসংখ্যানকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
উত্তর বাড্ডায় নিহত জামিল ও মেয়ে নুসরাত (ডানে)
বিএমবিএসের জরিপ ও গবেষণা নিয়ে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষা ও অর্থের অভাব, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। এছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অভাবের কারণেও এ ধরনের কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। আমাদের দেশে বিনোদনের মাধ্যমগুলোও এর অন্যতম কারণ। বিনোদনের নামে দেশের জনগণের ওপর কনফ্লিক্টের (দ্বন্দ্ব) বীজ দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো এজন্য অনেকাংশে দায়ী। তাদের পারিবারিক কলহ আমাদের দেশের দর্শকদের দ্বন্দ্বে জড়াতে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস, সঠিক শিক্ষা ও বিনোদন নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি পরিবারে বিচ্ছেদ ঘটছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সামাজিক অস্থিরতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা ও পারিবারিক কলহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, এ ধরনের সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই আছে। মূলত যাদের বেড়ে ওঠা সঠিকভাবে হয়নি, তারাই এ ধরনের আচরণ করে। এছাড়া এর পেছনে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা থাকতে পারে।
‘স্বামী মদ খাবে, টাকা না পেলে স্ত্রীকে মারধর করবে। এ ধরনের ঘটনা থেকেই সূত্রপাত হয় কলহের। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবও এর জন্য দায়ী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তারা মনে করে নিজেরা সর্বেসর্বা। তারা যেহেতু আয় করে তাই তারা মনে করে পুরো পৃথিবীই তার। আর যে সমস্ত নারী আয় করেন তারা পুরুষের এই একঘেয়েমি সহ্য করেন না, যা পারিবারিক কলহে রূপ নেয়। বিচ্ছেদও বাড়ে এ কারণে।’
কাকরাইলে নিহত শামসুন্নাহার ও ছেলে শাওন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা আক্তার বলেন, ‘মানবিকবোধের বিপর্যয়, বস্তুবাদী, সামাজিক সংহতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পরিবারকেন্দ্রিক বন্ধন কমে যাওয়াই পারিবারিক কলহের মূল কারণ।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিকীকরণের মধ্যে আগে যেমন পাস্পরিক সম্প্রীতি ছিল, সেখানে এখন অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা দেখা যাচ্ছে, আমরা বস্তুবাদী হয়ে যাচ্ছি। মানবিক সম্পর্ক এবং নৈতিকতার বন্ধন থেকে আজ মানুষ বস্তুকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একইসঙ্গে আগেরকার সময়ে আমাদের সামাজিক যে প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রীতি ছিল সেটিও কমে যাচ্ছে। যার কারণে মানুষ একতাবদ্ধ থাকছে না।’
‘তাদের একিভূত করে রাখার যে বিষয়গুলো ছিল; যেমন- ধর্ম, পরিবার, আত্মীয়তার বন্ধন- এগুলো কিন্তু আমাদের জীবন থেকে একেবারে উঠে যাচ্ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এক সময় সামাজিক কিছু নিয়ম-রীতি ছিল, যার মাধ্যমে এলাকার মাতব্বররা এসব সমস্যার মিউচ্যুয়াল (সমাধান) করে দিতেন। এগুলো কিন্তু এখন আর নেই।’
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধু পরিবার নয় আমাদের মধ্যে ছোটকালের স্কুলের শিক্ষকদের, প্রতিবেশী ও ধর্মীও নেতাদের শেখানো নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। রাষ্ট্রকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল করতে হবে। কমিউনিটি বেইজড প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে।
এআর/জেডএ/এমএআর/বিএ