ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ফারমার্স এনআরবি ও ইসলামী ব্যাংকের নানা অনিয়ম

সিরাজুজ্জামান | প্রকাশিত: ০৬:০৯ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

বর্তমান সরকারের আমলে অনুমতি পাওয়া দুটি ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অপর এক ব্যাংকের উচ্চপদে সরকারের ইচ্ছায় পর্ষদ পরিবর্তনের পর শুরু হয়েছে নানা অনিয়ম। এসব ব্যাংকে লোকসান ছাড়াও আগ্রাসী ব্যাংকিং, বেনামি শেয়ারহোল্ডার, বহিরাগতদের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্যগোপন করে পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনের নামে ঋণ প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে গ্রাহকদের আমানত।

রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠকে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।

ব্যাংক তিনটি হচ্ছে- দি ফারমার্স ব্যাংক , এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতিবিদদের দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদে ২০১২ সালে চতুর্থ প্রজন্মের নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদন পান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। আর ইসলামী ব্যাংক দেশে তিন দশক ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেলেও দুর্নীতির তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি এর পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করায় দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও।

ফারমার্স ব্যাংক

সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের মার্চ থেকে দি ফারমার্স ব্যাংক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকটি নিয়মের চাইতে বেশি ঋণ বা আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ে। পরিচালনা পর্ষদ স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শুরু করে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ। এছাড়া ব্যাংকটির যে পরিমাণ দায় রয়েছে তা পরিশোধেরও সক্ষমতা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যাংকটি নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুসরণ না করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে জামানত ছাড়া ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা তোয়াক্কা করছে না ফারমার্স ব্যাংক। নিয়ম লঙ্ঘন করে পরিচালকদের ঋণ প্রদানসহ একক ঋণগ্রহীতাকে অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। লোকবল নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে চার হাজার ৮২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৩০৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যার ১৭৬ কোটি ৪১ লাখ টাকার মন্দ ঋণ।

এছাড়া যাত্রা শুরুর দুই বছরের মধ্যে নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ফারমার্স ব্যাংকে একাধিকবার বিশেষ পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও ১৯ বার বিশেষ পরিদর্শন করা হয়। এসব পরিদর্শনে ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। আর্থিক অনিয়ম ঠেকাতে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও অবস্থার উন্নতি হয়নি ব্যাংকটির।

সর্বশেষ ১৭ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে গ্রহকের আমানত পাঁচ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা। কলমানি ঋণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত ৩০ কোটি টাকা। ক্রয়কৃত বিল ও বন্ড এক হাজার নয় কোটি টাকা।

দায় রয়েছে তা পরিশোধেরও সক্ষমতা নেই ব্যাংকটির। তাই আমানত গ্রহণ ও কর্জ করে চলছে ফারমার্স ব্যাংক। এছাড়া জুন শেষে ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। ব্যাংকটির ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি লোকসানে পরিণত হয়েছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক

২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন পায় চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ওই বছরের এপ্রিলে ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হয়। বেনামি শেয়ারহোল্ডার , বহিরাগতদের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্যগোপন করে পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনের নামে ঋণ প্রদানের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটি সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশে ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিত দেখান। ঋণের নিয়ম না মেনে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের ঋণ প্রদান। তথ্যগোপন করে প্রবাসীর পরিবর্তে দেশে বসবাসকারী ব্যক্তির নামে শেয়ার ক্রয়। বিধিবহির্ভূত ঋণ প্রদানে এমডির সম্পৃক্ততা। এছাড়া ব্যাংকিং নিয়ম অনুসরণ না করে পর্ষদের ছয় পরিচালকের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ ও তিন পরিচালককে অপসারণ। তবে সুপ্রিম কোট পর্ষদ সভার তিন পরিচালক এস এম পারভেজ, মো. আদনান ইমাম ও রফিকুল ইসলাম মিয়ার অপসারণ বাতিল করে দিয়েছেন।

ব্যাংকটির অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় এ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এসব বিধিবহির্ভূত ঋণ ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগের বিপরীতে তাদের কেন অপসারণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জবাব না নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।

জানা গেছে, ৪৬ ধারায় নোটিশ দিয়ে ব্যক্তিগত শুনানি শেষ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থায়ী কমিটি। এর আগে যেসব ব্যাংকের এমডিদের শুনানি করা হয় তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণও করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৯১ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের কারণে বিপুল অংকের অর্থ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে নিট মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ইসলামী ব্যাংক

২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। তিনজন শেয়ারধারী পরিচালক ও চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি হঠাৎ করে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ফের বড় পরিবর্তন আনা হয়। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি পদে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে বিধি বহির্ভূতভাবে বেশি ঋণ দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।

বর্তমানে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সংখ্যা ২০। এর মধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানিক শেয়ারধারণকারী পরিচালকের সংখ্যা তিনজন, শেয়ারধারণকারী দেশি পরিচালকের সংখ্যা ১০ জন এবং স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছেন সাতজন।

তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি পরিচালকরা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ২২ দশমকি ১৬ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন। এছাড়া বিদেশি তিন পরিচালকের কাছে রয়েছে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ শেয়ার।

বর্তমানে ব্যাংকটির বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কমছে। আগে যেখানে ৪৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ ছিল তা বর্তমানে নেমে ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করছে তা পড়লেই গা শিউরে ওঠে। এসব অনিয়মের দায় বোর্ডকে নিতে হবে। তারা দায় এড়াবেন কীভাবে?

প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পান কি না- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্য বলেন, ‘কিছুটা তো পায়ই। বেসরকারি ব্যাংক হলেও এটি পাবলিক প্রতিষ্ঠান। সরকারের আইনি কাঠামোর মধ্যে এবং জনগণের টাকায় এটি চলে। সেজন্য কমিটি এ বিষয়ে আলোচনা করেছে।’

‘ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম সংকট কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন’ বলেও মন্তব্য করেন কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, আজকের বৈঠকে এ কে এম শামীম উপস্থিত ছিলেন। এমডি হিসেবে তিনি আসার আগে এসব ঘটনা হয়েছে। এখন তারা সংশোধনের চেষ্টা করছেন।

বৈঠকে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা যেটা দেখেছি, সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক এগ্রেসিভ লোন দিচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা তাদের সতর্ক করেছি।

কমিটি সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটি সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, নাজমুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, মো. শওকত চৌধুরী ও আখতার জাহান অংশ নেন।

সংসদের গণসংযোগ অধিশাখা থেকে পাঠান প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠক এনএরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের পর সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. এর ঋণ বিতরণের হার আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকটির কোন খাতে কী ধরনের গ্রাহককে কী পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে তা আগামী বৈঠকে কমিটিকে অবহিত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এইচএস/এসআই/এমএআর/বিএ

আরও পড়ুন