যে ধামে সদাই কিনে মন ভরে না
‘মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি।’ মহাত্মা লালন ফকিরের অমর বাণী। ফকির লালনের সাধন-ভজনের মূলেই ছিল মানুষ। মানুষেই পরমাত্মার সন্ধান করে ফিরেছেন বাউলকূলের শিরোমণি লালন সাঁইজি।
লালন অনুরাগীরাও সে পথেই হেঁটে হেঁটে আত্মা-পরমাত্মার মেলবন্ধন খুঁজে-ফেরে। জাত-কূল-ধর্মের ধার ধারে না সাধকরা। সাধকের জাত ‘মানুষ’।
সে মানুষেরই হাট বসেছে সাঁইজির ধামে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া এখন সাধুর মেলা। কালিগঙ্গার তীরে আখড়াবাড়ি সাধুদের পদধূলিতে তীর্থস্থানে রূপ নিয়েছে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার সাধু-সন্ন্যাসী প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে ভজন-সাধনে মেতে উঠেছে।
কার্তিকের প্রথম বেলা। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লালন অনুরাগীরা দল বেঁধে আসতে শুরু করে আখড়াবাড়িতে। তবে সাধুদের আসা শুরু হয়েছে আরও ক’দিন আগে থেকেই। গেল ১৪ ও ১৫ অক্টোবর ভারত-বাংলাদেশ লালন পরিষদের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় সাধু সঙ্গের। সাধু সঙ্গে বাউল শিল্পী মমতাজ, আরিফ দেওয়ান, ভারতের অসীম সরকার, স্বপন অধিকারীসহ অসংখ্য গুণীজন মহাজনদের বাণী প্রচার করেন। সুর-যন্ত্রের মাখামাখিতে উম্মাদ বনে যায় সাধুজনেরা।
সোমবার (১ কার্তিক) সন্ধ্যায় লালন স্মরণ উৎসবের দ্বার উম্মোচন করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং লালন একাডেমির উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ লালনগীতি পরিবেশন।
১২৭ বছর আগে এমনই দিনে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাউল সাধক লালন ফকির। লালনের তিরোধান উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় লালন মেলা। এরই ধারাবাহিকতায় ১ থেকে ৩ কার্তিক পর্যন্ত (১৬ অক্টোবর-১৮ অক্টোবর) তিন দিনব্যাপী চলবে লালন মেলা।
মেলা শুরুর প্রথম প্রহরে ওপার বাংলা থেকে (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলা) এসেছেন সাধক স্বপন অধিকারী। ভারত-বাংলাদেশ লালন পরিষদের আয়োজনে সাধুসঙ্গে বাউল গানে মাতিয়ে রাখেন।
লালন দর্শন আর সাধুসঙ্গ প্রসঙ্গে কথা হয় এই বাউল সাধকের সঙ্গে। বলেন, প্রাণের টানে চলে এসেছি। বহুবার এসেছি। সাঁইজির বাণী আর সাধু সঙ্গের কথা স্মরণ হলে থাকতে পারি না। সীমানার ওপারে থাকি। কিন্তু প্রাণ পড়ে থাকে সাঁইজির ধামে। কত গুণী সাধকের পদধূলি এই ধামে। সে ধূলি গায়ে মাখতে পারলেই তো জীবন সার্থক।
কথা হয় সাধক বিমল দাস বাউলের সঙ্গে। বলেন, ৩৭ বছর থেকে সাঁইজির ধামে আসি। মূলত সাধু সঙ্গ পেতেই এখানে আসা। সাঁইজির ধামে সদাই কিনে মন ভরে না। যতবার এসেছি, ততবারই তৃষ্ণা বাড়িয়ে নিয়েছি। এ সুধা পানে তৃষ্ণা মিটে না গো। আরও বাড়ে।
বলেন, সাঁইজির কালামেই (বাণী) মুক্তি মেলে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আত্মাকে শিশু রূপ দিতে সাঁইজিই পথ দেখিছেন। মুক্তির তাড়ন থেকেই তার দেখানো পথে হাঁটতে চেষ্টা করছি।’
এএসএস/ওআর/আরআইপি