মিলার-ব্যবসায়ীদের কাছেই কি আত্মসমর্পণ?
সরকারি হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। আর বছরের হিসাবে এই বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশ। দাম কমাতে শেষে চালকল মালিক (মিলার), চাল ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ডেকে তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ করেছে সরকার। যদিও চালের দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের ভুল উদ্যোগের সঙ্গে মিলার ও ব্যবসায়ীদের মজুতদারি-কে দায়ী করা হচ্ছে। এ অবস্থায় মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধসহ সকল দাবি মেনে নেয়ার বিষয়টি সরকারের ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঈদুল আজহার আগে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। ঈদের পর সেই দাম এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এক বছর আগে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণে কষ্টে পড়েছে দরিদ্র মানুষ। সমালোচনার মুখে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রায় এক কোটি টন চাল মজুত আছে। ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মজুত করায় চালের দাম বেড়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা চাল নিয়ে চালবাজি ও রাজনীতি করছেন। অপরদিকে মজুতদারদের গ্রেফতারেরও নির্দেশ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশীদের চালকলেও অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে চালের দাম। চালের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সমালোচনার মুখে মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) চালকল মালিক, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সরকার। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন।
সেই বৈঠকে সরকারের নানা বক্তব্যের বিরোধীতা করেন মিলার ও ব্যবসায়ীরা। তারা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের নানা ভুল উদ্যোগ-কে দায়ী করেন। চরম হই-হট্টগোলের সভায় শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে মিলার ও ব্যবসায়ীদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক গতকাল বৃহস্পতিবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘চালের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ার কথা ছিল না, কিন্তু বেড়ে গেছে। এটার অন্যতম কারণ সরকারের ব্যবস্থাপনা। সরকারের পর্যাপ্ত মজুত ছিল না, এই সুযোগ ব্যবসায়ীরা নিয়েছে। এটা ঠিক অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তাল রেখে চালের দাম সেভাবে বাড়েনি। প্রতি বছর একটু একটু করে যদি দাম বাড়ত, তবে সেই বৃদ্ধি চোখে লাগত না। কৃষক কেন টাকা খরচ করে চাল করে, আপনাকে সস্তায় খাওয়ানোর জন্য তো না!’
‘তবে এই মুহূর্তে দাম বাড়ার কোনো বেনিফিট কৃষক পাচ্ছে না। এখন সরকারের উচিত পর্যাপ্ত আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল রাখা’- বলেন বীজ উইংয়ে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার ফারুক।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির সুযোগে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছেন। এটা সরকারেরও এক ধরনের আত্মসমর্পণ।’
সভায় ব্যবসায়ীরা চাল সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল পরিবহনের অনুমতি চান। প্লাস্টিকের বস্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার দাবি জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর দিয়ে ট্রেনে চাল পরিবহনের অনুমতি এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান বন্ধের দাবিও জানান তারা।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বস্তা নিয়ে আপনারা কথা বলেছেন, যে যে ব্যাগে আনতে পারেন সেভাবে আনবেন। টেন্ডারে (পাটের বস্তায় চাল আমদানির বিষয়টি) সংশোধন করে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আপনারা চাল আনুন।’
রহনপুর দিয়ে ট্রেনে চাল আনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা জেলা প্রশাসনকে আমরা যে নির্দেশনা দিয়েছিলাম...। যেহেতু আমরা আপনাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করছি, অবহিত হয়েছি, কোথায় কী আছে। এজন্য আমরা তাদের বলব, যাতে কোন ব্যবসায়ী হয়রানি না হয়। বন্ধু হিসেবে, আপন হিসেবে, সরকারও আপনাদের, আপনারাও আমাদের।’
প্লাস্টিকের বস্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার কারণে চালের দাম প্রতি কেজিতে দুই টাকা কমবে বলেও জানান মন্ত্রী। এসব পদক্ষেপের কারণে চালের দাম কমে যাবে বলে উপস্থিত চালকল মালিক ও কয়েকজন ব্যবসায়ী আশ্বাস দেন।
ওই বৈঠকে জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল বারী বলেন, ‘চাল আমদানির ট্যারিফ কমানো নিয়ে আপনাদের (সরকারের) সিদ্ধান্ত রঙ ছিল। আমাদের দেশে চালের সঙ্কট, আমরা ধীরে ধীরে চালের ট্যারিফ কমাচ্ছি। আর এ পর্যায়ে ইন্ডিয়ায় (ভারত) দাম বাড়ছে। তাহলে ট্যারিফ কমিয়ে লাভ হল কি?’
তিনি বলেন, ‘কৃষিমন্ত্রী যদি বলেন, আমি কৃষকদের ন্যায্য দাম দেব। বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা ট্যাক্স কালেকশন করব। খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় যদি বলেন, আমি দাম কমাব। পাট প্রতিমন্ত্রী যদি বলেন, আমি পরিবেশ রক্ষা করব। তাহলে স্যার আপনার কী প্রকিউরমেন্ট হবে? বলেন স্যার, বলেন।’
‘সারা পৃথিবীর মধ্যে কোন দেশে পাটের বস্তায় কেনা-বেচা হয়, দেখান স্যার। ট্যারিফ কমানো যুক্তিযুক্ত হয়নি। সময় মতো একেবারে সব তুলে দিতেন।’
আমিনুল বারী বলেন, ‘অটোমেটিক রাইস মিলে প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৪২ টাকা। আপনি স্যার (বোরো সংগ্রহে) মূল্য দিলেন ৩৪ টাকা। হাউ ক্যান ইট পসিবল! মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও আমরা চুক্তি করে ফেলতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী ভিয়েতনাম থেকে ২০ হাজার টন সিদ্ধ চাল আমদানি করলেন ৪৭৫ ডলার করে। সেই সময় যদি আমাদের বলা হতো তোমাদের ৪৫০ ডলার দাম দেব, তোমরা যেখান থেকে পার চাল এনে দাও, আমরা দিতে পারতাম। আমাদের সুযোগ তো দিচ্ছেন না!’
‘আমাদের প্রকিউরমেন্ট (আহরণ) হচ্ছে না, আপনার তো ব্যবস্থা নিতে হবে। সময় মতো ব্যবস্থা নিতে হবে’- যোগ করেন আমিনুল।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো ইন্ডিয়া থেকে চেষ্টা করেও চাল আনতে পারিনি।’
জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির নেতা আরও বলেন, ‘আপনি তো পারবেন না স্যার। হ্যাজার্ড (বিপত্তি) আছে। আপনি যখন ৪৭৫ ডলারে চাল আনছেন ইন্ডিয়াতে তখন ৩৮০ ডলার দাম ছিল।’
এ পর্যায়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তার কথার সাথে একমত, বাস্তব কথা বলেছেন।’
চালকল নেতা বারী বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, আমরা কৃত্রিম সঙ্কট করেছি। কী ধরনের সঙ্কট আমরা করেছি! আমাদের এক্সপ্লেইন (ব্যাখ্যা) করেন।’
এ পর্যায়ে চরম হট্টগোল সৃষ্টি হয়। অনেকেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন।
পর্যায়ক্রমে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর সমালোচনা করেন আরও কয়েকজন আমদানিকারক ও মিল মালিক।
বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল রশীদ বলেন, ‘মিটিংটি আগেই হওয়ার প্রয়োজন ছিল। যেহেতু সমস্যা হয়েছে, সরকারি গুদামে চাল দিতে আমরা দামটা একটু বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। (দাম না বাড়ানোর পরও) আমরা লস দিয়ে হলেও চুক্তির বেশির ভাগ চাল সরবরাহ করেছি।’
আরএমএম/এমএআর/আইআই