ভাষা জটিলতায় আটকা রোহিঙ্গাদের রোমহর্ষক বর্ণনা
শুক্রবার সকালে টেকনাফ উপজেলা শহর থেকে আমরা যখন সাবরাং ইউনিয়নের দিকে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তার দু'পাশে শত শত রোহিঙ্গাকে পাশ কেটে যাচ্ছিল আমাদের গাড়িটি। ওই ইউনিয়নের হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সামনে যখন পৌঁছালাম রোহিঙ্গা আসার গতি যেন আরও বেড়ে গেল। এ দৃশ্য সামনে যাওয়ার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিল। সেখানে গাড়ি রেখে সামনে যতই এগোতে থাকলাম রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের যেন ঢল নেমে এলো। রোহিঙ্গাদের ঢলে কোনোভাবেই সামনে এগোতে পারছিলাম না। তাদের ধাক্কায় বার বার পিছিয়ে পড়ছিলাম।
অবাক হয়েছি, চোখের সামনে দিয়ে ছোট ছোট রোহিঙ্গা শিশুদের সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা মাথায় নিয়ে ছুটতে দেখে। পেছনে বাবা-মায়ের কাছে ভারি ব্যাগ ও বস্তা থাকলেও শিশুদের চলার গতি ছিল তীব্র। অনেকে তাদের বাড়ির সোলার প্যানেলগুলোও খুলে নিয়ে এসেছেন।
অনেককে দেখেছি ক্লান্ত হয়ে পথের ধারে বসে পড়তে। আর যেন পারছে না তারা। তবে সবার হাঁটার গতি দেখে মনে হয়েছে কেউ যেন পেছন থেকে তাড়া করছে তাদের। সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সামনে যেন তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় অপেক্ষা করছে।
অবাক হয়েছি ভাঙাচোরা পাকা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের খোয়া ও পলেস্তারার ওপর খালি পায়ে হাঁটতে দেখে। তাও আবার কোনো রকমের যন্ত্রণার শব্দ না করে। ততক্ষণে কোনো রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে মুঠোফোন দিয়ে এসব দৃশ্য ধারণ করে যাচ্ছিলাম। সেখান থেকেই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল মিয়ানমারের আকাশ দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়তে। ক্লান্ত হয়ে যেসব রোহিঙ্গা রাস্তার ধারে বসে পড়েছিল তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছি, তারাও মাতৃভূমির আকাশের দিকে চেয়ে কি যেন দেখছিল। সম্ভবত, আমার মতো সেই কালো ধোঁয়াই দেখছিল তারা। হতে পারে তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ধোঁয়া।
আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে দেখলাম ৫-৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে কবুতর হাতে এগিয়ে আসছে। আগ্রহ বেড়ে গেল। ভাবলাম শত বিপদে থেকেও শিশুটি তার প্রিয় কবুতরটি নিয়ে দেশ ছেড়েছে। কাছে গেলাম। ছবি তুলতেই মেয়েটি হেসে দিল। নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, সিদ্দিকা। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলল, বার্মা। কে কে এসেছে সঙ্গে, তোমার বাবা কোথায়, এসব জিজ্ঞেস করার সময় সে মুখ হা করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। এরপর সে যা বলা শুরু করল তা শুনে আমিও হা করে চারপাশে তাকালাম। কোনো কিছু না বুঝেও বোঝার ভান করে বললাম যাও। সেদিন সিদ্দিকার ভাষা যদি বুঝতাম তাহলে কবুতরের পুরো কাহিনিটি পাঠককে জানাতে পারতাম।
একটু সামনে এগোতেই দেখলাম যার যার সাধ্য মতো রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাওয়া লোকজন। কেউ দিচ্ছেন খেজুর, কেউ কলা, কেউ সিদ্ধ ডিম, কেউ বাচ্চাদের নতুন পোশাক, কেউ নগদ টাকা, কেউ আবার চাল-ডালও।
সেখানেই কথা হয় বান্দরবানের লামা থেকে ত্রাণ দিতে আসা রমিজের সঙ্গে। ১১ বন্ধু মিলে তারা ট্রাক নিয়ে দিতে এসেছিলেন দুই কেজি চাল ও আধা কেজি করে ডাল। প্রায় তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে ত্রাণ সহায়তা করেছেন তারা।
রোহিঙ্গাদের মাঝে নগদ টাকা বিতরণের সময় কথা হয় ঢাকা থেকে যাওয়া সাকিব ও মামুনের সঙ্গে। তারা বলল, জনপ্রতি রোহিঙ্গাকে তারা ৩শ থেকে ৫শ টাকা করে দিয়েছেন। সব মিলে আড়াই লাখ টাকা বিতরণ করেছেন তারা।
টাকা দিলেন কেন? জানতে চাইলে তারা বলেন, যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তাদের যেতে হবে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং আশ্রয় কেন্দ্রে। এখান থেকে ওই এলাকার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। অথচ এসব রোহিঙ্গার কাছে কোনো বাংলাদেশের টাকা নেই। তারা সেখানে যাবে কীভাবে? এই টাকাটা তাদের গাড়ি ভাড়ার জন্য কাজে আসবে এবং কোথায় কোনো কিছু কিনে খেতে পারবে।
তাদের কথাগুলো পাশ থেকে শুনছিলেন স্থানীয় কয়েকজন। তারাও নিজ ইচ্ছায় কাছে এসে বললেন টাকা দেয়ায় ভালো হয়েছে। অন্য কিছু দিলে তাদের বহন করতে অসুবিধা হতো।
এ সময় চোখ পড়ল দুই রোহিঙ্গার দিকে। দেখলাম তারা বাঁশের মাঝখানে দড়ি দিয়ে দোলনার মতো বানিয়ে এক বৃদ্ধকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম আপনারা কি স্থানীয়? তারা বললেন, বার্মা। জানতে চাইলাম আজকেই কি বার্মা থেকে বের হয়েছেন, কোনো উত্তর নেই। হঠাৎ পাশে এসে একজন বলল, আপনার কথা তারা বুঝেনি। তিনি তখন তাদের ভাষায় আমাকে প্রশ্ন করলেন এবং উত্তরে জানালেন তারা ৭দিন আগে বের হয়েছে বার্মা থেকে। আজ সকালে পৌঁছেছে। শুনে অবাক হলাম। তার কাছেই জানতে চাইলাম এতদিন তারা ছিল কোথায়? তিনি পুনরায় তাদের ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন এবং তারাও কি কি যেন বললেন। কিছুক্ষণ পর দোভাষী নোমান জানান, এই কয়েকদিন তারা পাহাড় ও বিভিন্ন ধানখেতে ছিল। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ব্যাপক মারধর করেছে। তাই তারা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। নোমান স্থানীয় হলেও শুদ্ধভাবেই এসব জানান আমাকে।
যাই হোক, সেখানেই বেজে গেল দুপুর সাড়ে ১২টা। আবারও হাঁটা শুরু করলাম। সামনেই দেখলাম নদী পারাপারের ব্যবস্থা। কাছে গিয়ে দেখলাম নদী না, খাল। ভাবলাম এই খাল পার হয়েই সম্ভবত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কারণ ওপার থেকে প্রতিটি নৌকায় শুধু রোহিঙ্গারা এপারে আসছিল। দেখলাম আমার মতো কিছু বাংলাদেশি নৌকায় উঠছে ওপারে যাওয়ার জন্য। তাদের দেখে আমারও সাহস হলো। উঠলাম স্পিডবোটে। ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওপারে। ১শ টাকা ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম। দেখলাম সেখানেও রোহিঙ্গা আসার গতি ঝড়ের বেগে। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম সামনে কোথা থেকে এরা আসছে? তারা বললেন চার কিলোমিটার সামনেই শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাট। সেখান দিয়েই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। উঠলাম সিএনজি অটোরিকশার মতো দেখতে একটি গাড়িতে। ১০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম জেটিঘাটে।
সেখানে গিয়ে আরও অবাক হলাম। কারণ, সেই বহুল পরিচিত নাফ নদীর ওপর জেটিঘাট। ওপারেই মিয়ানমার, যা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার অংশে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে একের পর এক গ্রাম থেকে আকাশের দিকে কালো ধোঁয়া উঠছে।
জেটিঘাটের দুপাশে বসেছে গরু-ছাগলের বাজার। চলছে রমরমা ব্যবসা। অনেকেই বলছেন, এসব গরু-ছাগল রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পানির দামে কিনছেন স্থানীয়রা। তবে এ ব্যাপারে কোনো রোহিঙ্গার কাছে জানার সুযোগ হয়নি ভাষা না বোঝার কারণে। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললার সুযোগ হয়েছিল। তারা গরু-ছাগলগুলোর দাম স্বাভাবিকই বলছিলেন।
বিকেল ৩টা পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি নাফ নদী পার হয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে। প্রতিটি ট্রলারে তারা তাদের মালামালের সঙ্গে গরু ও ছাগলও নিয়ে আসছেন বাংলাদেশে। জেটিঘাটে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিজিবি সদস্যদের ছুটে যেতে দেখেছি ট্রলারের কাছে। একপর্যায়ে তাদের মাধ্যমেই দেখেছি গুরু-ছাগল বিক্রি হতে।
সেখানে পরিচয় হয় নোমানী নামে এক যুবকের সঙ্গে। সে কিছুদিন ঢাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালানোর পর এখন এলাকায় সিএনজি চালায়। তার সহযোগিতায় জেটিঘাটে কথা হয় রোহিঙ্গা রাইসুল, কালাম ও মাজেদুলের সঙ্গে। তারা সবে মাত্র নাফ নদী পেরিয়ে জেটিঘাটে এসেছে।
নোমানী তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর আমাকে জানালেন, এই তিন ব্যক্তি জনপ্রতি বাংলাদেশি সাড়ে ৮ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যে ট্রলারটিতে তারা নদী পার হয়েছে সেই ট্রলারের মালিক তাদের স্ত্রীদের সব গয়না, ৭টি ও ৪টি ছাগল নিয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রেখে দিয়েছে মাঝি।
নোমানী আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন তাদের সঙ্গে। এরপর জানালেন, জেটিঘাট থেকে মিয়ানমারের যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার পেছনেই থাকতো এই রোহিঙ্গারা। ৪ দিন শুধু লেগেছে তাদের পাহাড় পার হতে। যেদিন তারা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সেদিনই তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় সেখানকার সেনাবাহিনী। তারা সব সময় নারীদের নির্যাতন করতো। শিশুদের ছুড়ে মারতো। প্রতিনিয়ত তাদের নির্যাতন দেখে তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ চলে এসেছে।
এমএএস/এমএস