যুদ্ধের চশমা দিয়ে আগামী নির্বাচন দেখছি
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (একাংশ) সভাপতি। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। রাজনীতির কারণে কয়েক দফা কারাবরণও করতে হয়। সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। ষাটের দশকের একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিংড়ে লিখেছেন বই, অসংখ্য প্রবন্ধ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সমকালীন রাজনীতি, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মাসুদ রানা। দুই পর্বের ধারাবাহিকের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো।
জাগো নিউজ : আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কীভাবে দেখছেন?
হাসানুল হক ইনু : আমি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নভাবে দেখি। ভিন্নভাবে দেখি এজন্য যে, জঙ্গি দমনে একটা যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। যেহেতু যুদ্ধটা শেষ হয়নি, এখনও জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, রাজাকার চক্র এবং তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়া পিছু হটলেও আত্মসমর্পণ করেনি। ফলে বাংলাদেশে জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক চক্র দমনের যে যুদ্ধ, সেই যু্দ্ধ এখনও অব্যাহত আছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই আগামী বছরের ডিসেম্বরে বা শেষ নাগাদ যে জাতীয় নির্বাচন সেই নির্বাচনের আগে যুদ্ধটার সমাপ্তি করতে পারলে ভালো হয়। অর্থাৎ জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এবং তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আগুন যুদ্ধের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি যেন রাজনৈতিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। যদি না করে, আমরা যদি জঙ্গি-সন্ত্রাসকে ধ্বংস করতে না পারি তাহলে যুদ্ধের মধ্যেই নির্বাচনটা যথাসময়ে করতে হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই এই নির্বাচন করতে হবে।
এজন্য আমি বলছি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি যুদ্ধের চশমা দিয়ে নির্বাচনটা দেখছি। সুতরাং যারা রাজনৈতিক বিশ্লেষক আছেন তাদের সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। যুদ্ধের নিয়মেই আমি নির্বাচনটা দেখছি।
যারা আগুন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, যারা জঙ্গি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, যারা একাত্তরে খুন করেছে, যারা পঁচাত্তরে খুন করেছে, ২১ আগস্টের খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অগণতান্ত্রিক ও চক্রান্তের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা কোনো অবস্থাতেই কোনো অজুহাতেই নির্বাচনের নামে যেন গণতন্ত্রের লাইসেন্স না পায়। এটা আমার আকাঙ্ক্ষা, আমি রাজনীতিটাকে এভাবেই দেখছি।
এখন রাজনীতির মাঠকে রাজাকার, খুনি ও আগুন সন্ত্রাসীমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্রকে নিরাপদ করতে হলে রাজনীতির মাঠকে রাজাকার, খুনি ও আগুন সন্ত্রাসীমুক্ত করতে হবে।
জঙ্গি দমনের যুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করার যুদ্ধ নয়। যারা সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওকালতি করছেন তারা কার্যত নির্বাচনের অজুহাতে অগণতান্ত্রিক চক্রান্তের শক্তি, খুনিদের, আগুন সন্ত্রাসীদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, তাদের হালাল করার চেষ্টা করছেন। আগামী নির্বাচন যেন তাদের হালাল করার নির্বাচন না হয়।
বেগম খালেদা জিয়া আগুন যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে, জঙ্গি সন্ত্রাসীদের সমর্থন করে নিজেই গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেছেন। উনি বাংলাদেশের পথ পরিহার করে পাকিস্তানের পথে ওয়ানওয়ে টিকিট নিয়ে পাকিস্তানের ট্রেনে উঠেছেন। তার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথার আড়ালে বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে জনগণের আন্দোলন বাদ দিয়ে মাঠে সন্ত্রাস ও অসাংবিধানিক প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। তার সহায়ক সরকারের প্রস্তাব ভাসা, এর আইনগত ভিত্তি নেই। এটা বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে ও চক্রান্তের রাজনীতি উস্কে দিচ্ছে।
জাগো নিউজ : গত নির্বাচনের মতো বিএনপি যদি আবারও আন্দোলনে নামে?
হাসানুল হক ইনু : এবার নির্বাচন সামনে রেখে আমরা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সহ্য করব না। গণতান্ত্রিক সংবিধানের মধ্যে যে কোনো প্রস্তাব নিয়ে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সব সময় আলোচনা করতে আমরা রাজি আছি। বেগম খালেদা জিয়া কোনো কার্যকর প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেননি। ৯৩ দিনের আগুন সন্ত্রাসের কৈফিয়তও উনি দেননি।
খালেদা জিয়ার হাতে রক্তের দাগ, পিঠে দুর্নীতির ছাপ- এই অবস্থায় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উনার ফেরত আসা কঠিন কাজ। এজন্য উনি চাচ্ছেন বাংলাদেশকে সংবিধানের বাইরে ঠেলে দিতে।
উনি কোনোভাবেই আইনের ঊর্ধ্বে নন, কঠিন কিছু অপরাধের বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। এই অবস্থায় হাতে রক্তের দাগ ও পিঠে দুর্নীতির ছাপ নিয়ে গণতন্ত্রের ক্লাবে ফেরত আসার সম্ভাবনা আমি দেখি না।
ব্যক্তিগত অপরাধকর্ম ঢাকার জন্য তিনি যদি নিজ দল বিএনপিকে ব্যবহার করেন সেটা নেতাকর্মীরা বুঝবেন, সেখানে আমার কিছুই বলার নেই।
জাগো নিউজ : বিএনপি বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?
হাসানুল হক ইনু : প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন রাজনৈতিক নেতা যদি খুন করে, চুরি করে, তবে কি তার বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেয়া যাবে না? আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পর সাজাপ্রাপ্ত হলে রাজনীতির বাইরে চলে গেলে কি রাজনীতি শূন্য হয়ে যায়? রাজনীতিতে শূন্যতা বলে কিছু নেই। বিএনপি যদি দলগতভাবে সন্ত্রাসী দল হয় তাহলে গণতন্ত্রে তো সন্ত্রাসের কোনো জায়গা নেই।
খালেদা জিয়া রাজনীতির বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশের রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো শূন্যতা হবে না।
পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশে একবার রাজাকার সমর্থিত সরকার, একবার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার- রাজনীতির এই মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলছে। এজন্য বাংলাদেশের রাজনীতি বারবার হোঁচট খাচ্ছে এবং অস্থিতিশীলতা বজায় থাকছে। এই মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নে গতি আসবে না।
দীর্ঘ আট বছর ধরে যে যুদ্ধ করছি একে তুলনা করছি একাত্তরের যুদ্ধের সঙ্গে। এই নির্বাচনে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা বন্ধ করতে চাই। আর সামরিক সরকার চাই না। রাজাকার সমর্থিত কোনো সরকার চাই না।
নির্বাচনী মাঠ সমান সমান চাই, এর সঙ্গে আমিও একমত। কিন্তু এই মাঠে রাজাকাররা খেলবে না, যুদ্ধাপরাধীরা খেলবে না এবং খুনিরা খেলবে না। সেই মাঠে আগুন সন্ত্রাসের নেত্রীর খেলা উচিত না বলেই আমি মনে করি।
জাগো নিউজ : ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে আগামী নির্বাচনে ভিন্ন কোনো প্রেক্ষাপট সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন কি না?
হাসানুল হক ইনু : রায় নিয়ে সরকার নয়, বিএনপি রাজনীতি করছে। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা কার হাতে গেল তা নিয়ে যে বিতর্ক এর কারণে বাংলাদেশে কোনো সাংবিধানিক সঙ্কট হবে না। রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে না। যে কথাটা হচ্ছে- এই রায় যখন সংসদকে খাটো করে, ইতিহাসকে বিকৃত করে, এই রায় যখন বঙ্গবন্ধুকে তির্যক মন্তব্যের মাধ্যমে কটাক্ষ করে, তখন ওই রায় (ষোড়শ সংশোধনীর রায়) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে এবং চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে উৎসাহিত করে।
সেখানে আমার কথা হচ্ছে, বিচারপতিরা বিচার কাজ স্বাধীনভাবে করবেন, রাজনীতিতে নাক গলাবেন না। আদালতটা রাজনীতির মঞ্চ নয়।
কিন্তু আদালত যদি রাজনীতির মঞ্চে পরিণত হয়, বিচারপতিরা যদি রাজনীতিতে নাক গলানো শুরু করেন…, তারা ইতিহাস পাঠ করুক, বিকৃত ইতিহাস চর্চা করবেন না- এটা আশা করি।
ষোড়শ সংশোধনীর বিতর্কটা প্রধান বিচারপতি সৃষ্টি করেছেন। আমরা শুধু জবাব দিচ্ছি এবং এই জবাব দেয়াটা উচিত বলে মনে করি।
আরএমএম/এমএআর/আরআইপি