নিজের নয়, ওইদিন দেশ ও জনগণের কথা ভেবেছিলেন তিনি
আগস্ট মাস জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের জন্য অত্যন্ত শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের এই মাসেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের সেই আগস্ট মাসেই ফের আঘাত হানা হয়। এবার বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রাণ দিতে হয় আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মীকে। ওই হামলার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী। সেই দিনের সন্ত্রাসী হামলায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও নিজের কথা ভাবেননি শেখ হাসিনা। সেই ভয়াবহ মুহূর্তেও পরিচয় দিয়েছেন অকৃত্রিম দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি দেখিয়েছেন গভীর মমত্ববোধ, ভেবেছেন দেশ ও গণতন্ত্রের কথা।
ভয়াবহ ওই হামলার শিকার আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে জাগো নিউজ’র আলাপচারিতায় বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা বলেন, গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়েও শেখ হাসিনা সেদিন নিজের কথা ভাবেননি। তিনি ভেবেছেন দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের কথা। নিজের চিকিৎসার কথা চিন্তা না করে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা নিয়ে। খোঁজ-খবর নিয়েছেন কে কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
২১ আগস্টের হামলার শিকার বর্তমান সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল তৎকালীন জোট সরকারের অব্যাহত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের শান্তির সমাবেশ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে করা হয়েছিল সমাবেশের প্রধান অতিথি। ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর মৃত্যুপুরী থেকে নেত্রীকে আমরা উদ্ধার করে নিয়ে আসি। শেখ হাসিনা ওখান থেকে কোনওভাবেই আসবেন না।
ওই হামলার পর আমরা যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবছি শেখ হাসিনা তখন সেসব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করছিলেন দেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের কথা। তিনি ভাবছিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার কথা।
মায়া আরও বলেন, আমরা যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবছি, তখন তিনি দলীয় নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, এখন কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া যাবে না। হরতাল কর্মসূচি দেয়া যাবে না। আগে আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। নিহতদের দাফন সম্পন্ন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২১ আগস্টের পরে নেত্রী আমাদের সবাইকে ডেকে শুধু এটুকু বলেন, তোমরা সবাই হাসপাতালে যাও। কে কোন হাসপাতালে আছে, কার অবস্থা কেমন, দেখে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত কর। আর আমাকে তথ্য দিয়ে আপডেট রাখ।
খালিদ বলেন, নেত্রী কিছুক্ষণ পরপর খোঁজ নিতেন, আহত কার অবস্থা কেমন। অথচ নেত্রী নিজেও গুরুতর আহত ছিলেন। কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু নিজের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেননি তিনি। চিকিৎসা নিতে দেরি হওয়ায় এখন নেত্রীর এক কান প্রায় অচল।
হামলার শিকার তৎকালীন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, আমি, আইভি আপা, ইলিয়াস মোল্লা ও মোস্তাক আহমেদ সিন্টু ভাই মঞ্চের সামনে বসেছিলাম। নেত্রীর বক্তব্য শেষ হলে আইভি আপা মঞ্চের সামনের দিকে যান তার সঙ্গে দেখা করতে। সেন্টু ভাই পার্টি অফিসের দিকে রওনা দেন। তখনই গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। সেন্টু ভাই গ্রেনেডের আওয়াজ শুনেই ফের সামনে চলে আসেন। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।
তিনি বলেন, আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি ট্রমা সেন্টারে। পরে জানতে পারি সেন্টু ভাই মারা গেছেন। ট্রমা হাসপাতাল থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে আমাকে নিয়ে আসেন ড. প্রাণ গোপাল দত্ত। নেত্রী লোক পাঠিয়ে সব সময় আমাদের চিকিৎসার খবর নিতেন।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. প্রাণ গোপাল দত্ত ওইদিনের ঘটনায় শেখ হাসিনার অনুভূতির কথা জাগো নিউজ’র কাছে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমি তখন চেম্বারে, হঠাৎ সুধাসদন থেকে ফোন আসে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি দ্রুত চলে যাই নেত্রীর কাছে। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে যাও। আমি নেত্রীকে দেখলাম আহত। বিবর্ণ, বীভৎস ও অসহায় অবস্থায় নিচতলায় বসে আছেন।
সেখানে অনেক ডাক্তার উপস্থিত ছিল। নেত্রীর অবস্থা দেখে চিকিৎসার কথা বললাম। জবাবে তিনি বলেন, আগে আমার নেতাকর্মীদের বাঁচাও। আমি পরে চিকিৎসা নেব।
সেদিন আমি একজন ভালো রাজনীতিবিদ ও দেশপ্রেমিক শেখ হাসিনাকে চিনেছি। ওইদিন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এই মুহূর্তে দেশবাসীর ভেতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী দিশেহারা। এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক হবে না। আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি দেশবাসীকে তা জানাতে হবে; না হয় গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়তে পারে। শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে পারে। দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। আমি এটা হতে দিতে পারি না।
তিনি বলেন, পরের দিন ২২ আগস্ট আবার সুধাসদন থেকে ফোন পাই। সঙ্গে সঙ্গে চলে যাই। নেত্রীর দুই কানে শো-শো শব্দ হচ্ছিল, কোনো কিছু তিনি ভালো করে শুনতে পারছিলেন না। আমি কান ভালো করে পরীক্ষা করলাম। নেত্রীর কান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক নেত্রীকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেই। নেত্রী বলেন, আমি কোথাও যাব না। শত শত নেতাকর্মীকে আহত রেখে আমি শুধু নিজের জন্য বিদেশে যেতে পারি না।
দ্রুত চিকিৎসা না নেয়ায় নেত্রীর কানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এখন ডান কানে একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেন তিনি। যদি সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিকিৎসা নিতেন হয়তো তার এই ক্ষতি হতো না।
এইউএ/এমএঅর/আরআইপি