ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সফল উদ্যোক্তা হতে ধৈর্য প্রয়োজন

মামুন আব্দুল্লাহ | প্রকাশিত: ০৫:৪৫ এএম, ২১ জুলাই ২০১৭

একজন সফল ও তরুণ উদ্যোক্তা কাজী সাজিদুর রহমান। ব্যবসা শুরুর মাত্র চার বছরেই পেয়েছেন ‘জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার- ২০১৬’। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে। কাজী পেপার কাপ বা কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে যে ব্যবসায়িক ধারণা তিনি নিয়ে এসেছেন তা স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব। তার এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ১৯০টিরও বেশি কর্পোরেট হাউস। নেপাল ও মালয়েশিয়ায় রফতানি হচ্ছে সাজিদের কাগজের কাপ-প্লেট।

সম্প্রতি তরুণ এ উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজ’র। কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে তার স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ। ‘সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সহনশীলতা ও ধৈর্য’- এমন মন্তব্য করে ব্যবসায়িক নানা প্রতিবন্ধকতা এবং তা নিরসনে সুষ্ঠু, কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে উঠতি তরুণদের মধ্যেও স্বপ্নের বীজ বপন করিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুন আব্দুল্লাহ

জাগো নিউজ : তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে কাগজের কাপ-প্লেট তৈরির পেছনের গল্প সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি? 

কাজী সাজিদুর রহমান : সময়টা ২০১০ সাল। শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের আগেই আমি বাজার থেকে বের হয়ে আসি। এরপর মাকে নিয়ে পবিত্র হজ পালনে যাই। একদিন মদিনা শরীফে হযরত মোহাম্মদ (সা.)- এর রওজা মোবারকে প্রথম সারিতে বসেছিলাম। এমন সময় কেউ একজন রোজা আছি কিনা জানতে চেয়ে ইফতারের জন্য কাগজের তৈরি দুটি কাপ দিয়ে যান। যার একটিতে ছিল জুস, অন্যটিতে খেজুর। খেজুরের কাপটির সাইজ বড় হওয়ায় তা শেষ করতে পারিনি। খেজুরগুলো নিয়ে আমি তাঁবুতে ফিরি। মধ্যরাতে ক্ষুধা পেলে কাগজের ওই কাপ বের করে খেজুর খেতে খেতে এ ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে।

জাগো নিউজ : এত কিছু থাকতে কাগজের কাপ-প্লেট কেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : বর্তমান বিশ্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। আমরা নিজেরাও দেশের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি। অযাচিত প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারে ঢাকা শহরের ড্রেনগুলোর ভয়াবহ চিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি। নদীর পানি দূষণ, মাটির উর্ভরতা কমে যাওয়া এমনকি রাজধানীজুড়ে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে এর পেছনে বড় কারণ প্লাস্টিক ও পলিথিন। সবকিছু বিবেচনা করে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি তৈরি এবং তা ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হই। 

প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে পারলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশ দূষণের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে- এমন চিন্তা থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য হিসেবে কাগজের কাপ-প্লেট তৈরির উদ্যোগ নেই।

জাগো নিউজ : হজ থেকে দেশে ফিরেই কি ব্যবসা শুরু করলেন? 

কাজী সাজিদুর রহমান : দেশে ফিরেই আমি ব্যবসা শুরু করিনি। এ সম্পর্কে বিশদ জানতে অনেক পড়াশোনা ও চিন্তা-ভাবনা করেছি, মার্কেট এনালাইসিস করেছি, অনেকের সঙ্গে পরামর্শও করেছি। এরপর ব্যবসা শুরুর ব্যাপারে ডিটারমাইন্ড হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করি। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে কিছুদিন পর মালয়েশিয়ার এলেক্স কোম্পানিতে যাই। সেখান থেকে চায়না; এভাবে দুই বছর ধরে নিজেকে তৈরি করেছি। 

জাগো নিউজ : শুরুটা কিভাবে করলেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : হজ থেকে ফেরার দুই বছর পর অনেক শ্রম আর একনিষ্ঠতার জোরে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ১২শ স্কায়ার ফিটের একটি কারখানা নেই। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কারখানাটি আমি নিজেই প্রস্তুত করেছি। কোনো ব্যক্তিকে আমার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেইনি। দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়ে তাদের সঙ্গে কারখানাটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেছি। এরপর গড়ে তুলি কেপিসি ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কোম্পানি। যেদিন প্রথম মেশিন দেশে আসে, সেদিন তিনজনকে কোম্পানিতে নিয়োগ দেই।

জাগো নিউজ : পুঁজি পেলেন কোথায়?

কাজী সাজিদুর রহমান : ২০১২ সালের আমার কাছে ছিল ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এত অল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন ছিল। মূলধন স্বল্পতা দূর করতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলি। তারা অর্থায়ন করে। কিন্তু সেটা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ব্যাংকটিতে এক কোটি টাকার ঋণ চাইলে দিয়েছিল ৩৩ লাখ টাকা। এরপর তিনটি মেশিন দিয়ে পেপার কাপ ও প্লেট তৈরি শুরু করি। 

জাগো নিউজ : ২০১২ সালে শুরু করে ২০১৬- তে পেলেন জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার। মাত্র চার বছরেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন পরিচিতি। এত দ্রুত সফলতা, কিভাবে সম্ভব হলো? 

কাজী সাজিদুর রহমান : আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা এ ব্যবসার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। প্রথম দুই মাস কাগজের কাপের সেম্পলিং করেছি। একই সঙ্গে কাপের একটি বড় মজুদ গড়ে তুলি। এরপর মাল্টিন্যাশনাল একটি কোম্পানিতে নিজের তৈরি করা কাপের সেম্পল নিয়ে কথা বলি। আপনাকে বলে রাখি, তারা আগেই এ ধরনের কাপের ইউজার ছিল। বিদেশ থেকে আনত। আমার তৈরি কাপ দেখে তারা খুবই খুশি হয় এবং একবারে দুই লাখ পিস কাপের অর্ডার দেয়। এটিই আমার জীবনের ব্রেকথ্রু। অর্ডার পেয়ে আমি প্রথম ফোনটা বাবাকে দেই। তখনই মনে হলো, আমার দ্বারা ভালো কিছু করা সম্ভব।

sajedur

জাগো নিউজ : দেশের ১৯০টিরও বেশি কর্পোরেট হাউজ এখন আপনার ক্লাইন্ট। কিভাবে নামিদামি এসব প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করলেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : বিশ্বের সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিই অনেক কিছু বিবেচনা করে বিজনেস পার্টনার নির্ধারণ করে। কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখার জন্য আমার কারখানায় নিযুক্ত আছে সুশিক্ষিত ও সুপ্রশিক্ষিত কর্মচারী ও শ্রমিক। এসব কারণে গুণগত মান সবসময় নিশ্চিত হচ্ছে। আমার কারখানাতে এইচএসিসিপি বা হেসাপ (হ্যাজারড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্টস) প্র্যাকটিস করা হয়। এছাড়া নিজস্ব ল্যাব রয়েছে। এখানে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা করা হয়। কাগজের গায়ে ১০০ ভাগ পরিবেশবান্ধব আস্তরণ বা প্রলেপ ব্যবহার হয়। কাগজের ওপর পলিথিলিন নামক পদার্থে একটি প্রলেপ বা আবরণ রয়েছে, যেটি শতভাগ পচনশীল পদার্থ। যা মাটির সংস্পর্শে যাওয়ার ২১ দিনের মধ্যে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।

জাগো নিউজ : আপনার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন? 

কাজী সাজিদুর রহমান : আমার প্রতিষ্ঠান থেকে এখন প্রতিদিন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি হচ্ছে প্রায় তিন লাখ পিস কাগজের কাপ ও প্লেট। শুরুতেই দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান প্রাণ, পেপসি, ইস্পাহানি, ঈগলু ও বিএফসির মতো বড় বড় ব্র্যান্ডের অর্ডার পেতে শুরু করি। এখন বিদেশে রফতানির অর্ডার পাচ্ছি। ইতোমধ্যে নেপাল ও মালয়েশিয়াতে কাপ-প্লেট রফতানি করছি। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডসের ক্রেতাদের কাছ থেকে পেপার কাপ নেয়ার জন্য ক্রয় আদেশ পেয়েছি। ভাবতে ভালো লাগে, আমার তৈরি, বাংলাদেশে তৈরি পরিবেশবান্ধব কাপ-প্লেট দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।

জাগো নিউজ : শুরুতে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : ব্যবসা শুরুর পরপরই দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। বলতে গেলে আমার ব্যবসায়িক সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপরও আমি হাল ছাড়িনি। এছাড়া মূলধর ঘাটতি, ব্যবসায়িক লোনের চিন্তা-তো ছিলই। সব মিলিয়ে শুরুতে বড় একটা ধাক্কা সামাল দিতে হয়েছে।

জাগো নিউজ : দেশের লাখ লাখ তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের কী পরামর্শ দেবেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : আমি মনে করি সফল উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম শর্ত হলো ধৈর্য। কোনোভাবেই ধৈর্য হারা হলে চলবে না। সমস্যা আছে এবং থাকবেই। এগুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। ধৈর্য আর অধ্যবসায় থাকলে সফলতা আসবেই।

জাগো নিউজ : ব্যবসা পরিচালনায় এখন কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?

কাজী সাজিদুর রহমান : দেশে প্রতি মাসে প্লাস্টিকের পণ্যের বাজার পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকা, যা কাগজের বাজারের তুলনায় ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তবে একই দামে প্লাস্টিক ও কাগজের কাপ পাওয়া গেলে যে কেউ কাগজেরটাই পছন্দ করবে। এর চাহিদা বাড়বে। পরিবেশ রক্ষা পাবে। তবে আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো শিল্পপ্লট বরাদ্দ নেই। তেজগাঁওয়ের মতো ব্যয়বহুল জায়গায় বেশি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে লাভ করা বা ব্যবসা চালানো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অসম্ভব। আমরা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করি তা পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বের সব দেশে এ পণ্যের কোনো ডিউটি (শুল্ক) দিতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ২৫ শতাংশ আয়করসহ কাঁচামাল আমদানি করতে ৬১ শতাংশ ডিউটি দিতে হয়। এটি এখন মূল বাধা। 

আমার একটি পণ্যের (কাপ) দাম দেড় টাকা। আর প্লাস্টিকের গ্লাসের দাম ৯০ পয়সা। দেড় টাকা থেকে ডিউটি বাদ দিলে এর দাম পড়বে ৯০ পয়সা। অর্থাৎ প্লাস্টিকের সমান দাম। ডিউটি-ই (শুল্ক) এখন এ ব্যবসার বড় বাধা।

জাগো নিউজ : আর কোনো সমস্যা আছে কি না? 

কাজী সাজিদুর রহমান : বিদেশ থেকে আমদানির সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা কাস্টমসে প্লাস্টিকের এসব পণ্য পিস হিসাবে না দেখিয়ে কেজি হিসাবে দেখায়। ফলে প্রতি কাপের দাম পড়ে মাত্র ১০ পয়সা। অথচ বাজারে এসব কাপের দাম এক থেকে তিন টাকা। ফলে এখানেও শুল্ক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। মার খাচ্ছেন দেশের উদ্যোক্তারা। এজন্য বিদেশ থেকে এভাবে পণ্য আমদানি ঠেকাতে জতীয় রাজস্ব রোর্ডকে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আমরা সহায়তা করব।

এছাড়া অধিকাংশ দেশে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে মাত্র ৫-৭ শতাংশ শুল্ক নেয়। কোনো কোনো দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে গড়ে ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নেপালসহ অন্য দেশে ৭ শতাংশের মতো শুল্ক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কাঁচামাল আমদানিতে দিতে হয় ৬১ শতাংশ শুল্ক। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে বাজার হারাচ্ছে শিল্পটি। এটা কমানো উচিত। 

এমএ/এমএআর/এআরএস/এমএস

আরও পড়ুন