ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

এখনও সচল হাজারীবাগের ট্যানারি

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১২:০১ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৭

এখনও উৎপাদন কার্যক্রম চলছে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে। তবে আগের তুলনায় কমে এসেছে কাজের পরিধি। 

ওয়েট ব্লু’র (চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রথম ধাপ) পরের কার্যক্রমগুলো চলছে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে প্রকাশ্যেই চামড়া শুকানো, নরম করা, রঙ করা, চামড়ায় ভাজ না পড়া সংক্রান্ত কার্যক্রম চালানো হচ্ছে হাজারীবাগে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাজারীবাগে ট্যানারির সব কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেন আদালত। পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে গত ৮ ও ৯ এপ্রিল হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

তবে পরিবেশ অধিদফতরের ওই সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার এক সপ্তাহ পরই আবারও হাজারীবাগের কারখানাগুলোতে সংযোগ দেয়া শুরু হয়। একে একে প্রায় সবকটি কারখানায় সেবা সংযোগ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। 

গতকাল সোমবার হাজারীবাগ অঞ্চল ঘুরে এবং ট্যানারি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

tanari

হাজারীবাগের রাস্তা দিয়ে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি ও পিকাআপে ভেজা ও শুকনা চামড়া কারখানাগুলোতে আনা-নেয়া করা হচ্ছে। তবে কারখানাগুলোর প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়েছে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে ভেতরে কাজ চলছে। কোনো কারখানায়ই অপরিচিত ব্যক্তিদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

হাজারীবাগে একাধিক কারখানা রয়েছে এমন মালিকদের কেউ কেউ একটি কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে অন্যগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছেন। যে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে না। বন্ধ কারখানার গেটে নামমাত্র পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজারীবাগের ট্যানারি মোড়ে অবস্থিত ‘অ্যাপেক্স ট্যানারি’র সামনের ‘করিম লেদার’ কারখানাটির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই কারখানার পাশেই আর একটি কারখানা সচল রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। সচল থাকা কারখানাটির সামনের রাস্তায় কয়েকটি ড্রাম খুলে রাখা হয়েছে।

কারখানাটির ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মী বাধা দেন। বাধার মুখে কারখানাটির সামনে বেশকিছু সময় অবস্থান করে দেখা গেছে, তৃতীয় তলায় দড়ি টাঙিয়ে ও সানসেটে ঝুলিয়ে চামড়া শুকানোর কার্যক্রম চলছে।

tanari

‘আইয়ুব ব্রাদার্স’ ট্যানারির সামনে গিয়ে দেখা গেছে, কারখানাটির প্রধান গেট বন্ধ রেখে ভেতরে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রধান গেটের সঙ্গে থাকা পকেট গেটে সব সময় দু-একজন অবস্থান করছেন। মাঝে মধ্যে ওই পকেট গেট খুলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারখানার ভেতরে প্রবেশ করছেন এবং বের হচ্ছেন। 

গেটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার কারখানাটির ভেতরে প্রবেশ করে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অনুমতি পাওয়া যায়নি।

তবে কারখানাটির সামনের রাস্তায় কিছু সময় অবস্থান করে দেখা যায়, একটি ভ্যানগাড়ি বোঝাই করে কারখানার ভেতর থেকে চামড়া অন্যত্র নেয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দু’জন শ্রমিক গোল করে মোড়ানো চামড়া রিকশায় অন্যত্র নিয়ে যান। কারখানাটির ভেতর থেকে ওই চামড়া বের করার দৃশ্য জাগো নিউজের ক্যামেরাবন্দি করা হয়। 

ট্যানারি মোড়ে অবস্থিত ‘রূপালী- ২’ কারখানা। কারখানার সামনে গিয়ে প্রধান গেটের সঙ্গে থাকা পকেট গেট দিয়ে দেখা যায় ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছেন। প্রধান গেটটি তালাবদ্ধ। পকেট গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেন দায়িত্বরত কয়েকজন। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে কারখানার ম্যানেজার দাবি করেন। নাম জানতে চাইলে তিনি জানাতে অস্বীকার করেন। 

কারখানার ভেতরে কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব আগের মাল। নতুন কোনো মাল এখানে আনা হচ্ছে না। এটি মূলত আমাদের গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গোডাউনের ভেতরে ব্যারেলে বিভিন্ন কেমিক্যাল রাখা হয়। আমাদের ট্যানারির সব কার্যক্রম এখন সাভারে (হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী) চলছে। এখানে কিছু ফিনিশড চামড়া রয়েছে।

কয়েকজন শ্রমিককে এ সময় ওয়েট ব্লু করা ভেজা চামড়া নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব আগের চামড়া। আমরা এখানে সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। এখন কারখানা থেকে বের করে অন্য কারখানায় নিয়ে যাব। 

কারখানাটির সামনে এরপর আরও আধাঘণ্টার মতো অপেক্ষা করা হলেও কোনো চামড়া বাইরে বের হতে দেখা যায়নি। তবে কারখানাটিতে কাজ করেন এমন একজন শ্রমিক জানান, ‘রূপালী- ২’ কারাখানাটিতে অল্পপরিসরে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ হয়। প্রতিষ্ঠানটির পাশে অবস্থিত ‘রূপালী’ কারখানায় মূলত চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মূল কাজ হয়। সেখানে শ্রমিক ও কর্মকর্তা ছাড়া বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সব সময় প্রধান গেট বন্ধ রাখা হয়।

‘রূপালী’ কারখানার সামনে গিয়ে ওই শ্রমিকের কথার সত্যতা পাওয়া যায়। প্রধান গেটটি এমনভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে দেখে মনে হবে কারখানাটি বন্ধ। তবে কিছু সময় অবস্থান করে কারখানাটির ভেতর থেকে শ্রমিকদের বাইরে বের হতে এবং বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়।

tanari

‘আইয়ুব ব্রাদার্স’ ট্যানারির এক শ্রমিক জানান, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অংশ হিসেবে ট্যানারিতে প্রায় ৪০ ধরনের কাজ আছে। এর মধ্যে সখিনা, ব্লু, ডাই, বেগম, সিটিং- এ কাজগুলো হয় সাভারে। বাকি সব কাজ এখনও হাজারীবাগে হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চামড়ায় রঙ করার জন্য স্প্রে করা, নরম করার জন্য ভাইব্রেটিং করা, ভেজা চামড়া শুকানোর জন্য ট্যানার, ফিনিশিংয়ের জন্য প্লেট করা।

ওই শ্রমিক জানান, ড্রামের ভেতরে কেমিক্যাল দিয়ে কাঁচা চামড়া থেকে পশম উঠানো হয়। পশম উঠানো চামড়া সিটিংয়ের পর বেগম করা হয়। বেগম হচ্ছে সিটিং করা চামড়ায় যাতে কোনো ভাজ না পড়ে সে প্রক্রিয়া। বেগম করার পর ট্যানার করা হয়। ট্যানারের মাধ্যমে গ্যাসের সাহায্যে ভেজা চামড়া শুকানো হয়। 

হাজারীবাগের কারখানায় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আদালত সর্বশেষ যে রায় দিয়েছেন, সেই রায় অনুযায়ী পরিবেশের ক্ষতি হয় না এমন কার্যক্রম হাজারীবাগের ট্যানারিতে করা যাবে। এ কারণে যেসব কারখানা ড্রাম সরিয়ে নিয়েছে এবং পরিবেশ দূষণ করে এমন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে তাদের পুনরায় বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। 

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. রইছউল আলম মন্ডলের মন্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।  

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে ১৯৫০ সালে হাজারীবাগে শুরু হয় ট্যানারির কার্যক্রম। সেই সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা ২১টি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিমালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ট্যানারির কার্যক্রম শুরু করে। এরও আগে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে ‘ঢাকা ট্যানারি’র হাত ধরে বাংলাদেশে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত।

নারায়ণগঞ্জে ‘ঢাকা ট্যানারি’ নামের প্রথম কারখানাটি গড়ে তোলেন আর বি সাহ নামের এক ব্যবসায়ী। তার হাত ধরে গড়ে ওঠা ঢাকা ট্যানারির অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে এর মালিকানা বদলি হয়েছে কয়েকবার। নারায়ণগঞ্জে ঢাকা ট্যানারির কার্যক্রম চলে প্রায় তিন বছর।

ঢাকা ট্যানারির পাশাপাশি হাজারীবাগে ট্যানারি কার্যক্রম শুরু করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান ক্রোম ট্যানারি বা ঢাকা হাইডেন, দিলকুশা ট্যানারি, ইস্ট বেঙ্গল ট্যানারি, পাকিস্তান ট্যানারি, এসএনএ ট্যানারি, ইউনাইটেড ট্যানারি, হাফিজ ট্যানারি, রহমানিয়া ট্যানারি, ন্যাশনাল ট্যানারি, বেঙ্গল ন্যাশনাল ট্যানারি, মাহতাব ট্যানারি, নর্থ ইস্ট ট্যানারি, ফেরদৌস ট্যানারি, বেঙ্গল কর্পোরেশন, ওরিয়ন ট্যানারি, রাজ্জাক ট্যানারি, পাইওনিয়র ট্যানারি, মাহতাব-২ ও ওমর ট্যানারি। সবকটির মালিক পাকিস্তানের ছিলেন।

বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা পাকিস্তানের ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া এ শিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে ট্যানারির সংখ্যা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। 

tanari

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণ করা ২১টি ট্যানারি বেসরকারি খাতে দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের পর ছোট ছোট কিছু ট্যানারি গড়ে উঠলেও বড় কোনো ট্যানারি গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে হাজারীবাগে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ ট্যানারি আছে।

হাজারীবাগ থেকে এসব ট্যানারি সরাতে পরবর্তীতে সরকার উদ্যোগ নেয়। এজন্য ২০০৩ সালে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী। এ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়।

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ (সিইটিপি) অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করতে পারেনি। গত ১৩ বছরে বেশ কয়েক দফায় সময় বেঁধে দেয়ার পরও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে হেমায়েতপুরে নিয়ে যাননি মালিকরা।

এমন পরিস্থিতেই বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারির সেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি) সংযোগ বিচ্ছন্ন করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের আপিল বিভাগ।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি বছরের ৬ এপ্রিলের মধ্যেই হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোনসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা ছিল পরিবেশ অধিদফতরের। তবে পরিবেশ অধিদফতর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম শুরু করে ৮ ও ৯ এপ্রিল। 

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজারীবাগে এ শিল্পের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে পরিসমাপ্তির কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। এখনও সচল রয়েছে সেখানকার কারখানাগুলো।

এমএএস/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন