হামলার আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন আইজিপি
গত বছরের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিসান বেকারির জঙ্গি হামলা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। গুলশানের মতো হাই সিকিউরড ও কূটনৈতিক এলাকায় এ ধরনের ভয়াবহ হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ায় বিস্মিতও হয়েছেন অনেকে। এর ক’দিন পর দেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান কিশোরগঞ্জ সদরের শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টা নিয়েও বেশ আলোচনা হয়। সেখানে হামলার চেষ্টাকালে প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও এক নারী।
ওই সময় দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাসও তাদের নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করে। শঙ্কায় দেশ ছাড়েন অনেক কূটনীতিক; এমনকি বাংলাদেশের ভ্রমণ সূচিও বাতিল করে কেউ কেউ! এসব হামলার জের ধরে ওই সময় পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাকেও দোষারোপ করা হয়। কারণ তারা আগে থেকে কোনো সতর্কবার্তা দিতে পারেননি।
হামলার পরপরই অনেকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে বলেই এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে। গোয়েন্দা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। তবে তাদের ধারণা ভুল ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
একাধিক সূত্র বলছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার আগাম তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে ঠিকই ছিল। বিষয়টি জানতেন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত এএসপি ও পরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার জনসম্মুখে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও সেভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
পুলিশের পরিদর্শক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রামপুরা বিভাগের এক থানার পরিদর্শক বলেন, ‘গুলশান হামলার ২-৩ সপ্তাহ আগে হঠাৎ একদিন ওয়াকিটকিতে আইজিপি স্যারের পক্ষ থেকে বিশেষ একটি বার্তা পাঠানো হয়েছিল। এতে সবাইকে অ্যালার্ট থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। ইউনিট ভাগ করে সবাইকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।’
পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে ম্যাসেজ ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সেসব স্থানের মধ্যে গুলশানের নামও উল্লেখ ছিল। তবে সুনির্দিষ্ট স্থান, হোটেল বা রেস্টুরেন্টের নাম বলা ছিল না।’
তবে হামলার আগাম বার্তায় গুলশান অঞ্চলের নাম শোনার পরপরই সাধারণ মানুষকে না বুঝতে দিয়ে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বাড়ানো হয় পেট্রোল ডিউটিতে কর্মরত পুলিশের সংখ্যাও।
এদিকে ওই হামলার কয়েক দিন পর আগাম তথ্য থাকার বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। জনমনে প্রশ্ন জাগে, আগাম তথ্য থাকার পরও কেন প্রতিরোধ করা গেল না। পরে বিষয়টি অবশ্য স্পষ্ট করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গোয়েন্দাদের কাছে যে আগাম তথ্য ছিল, তাতে সুনির্দিষ্ট করে আর্টিসান বা শোলাকিয়ায় হামলা হবে তা ছিল না। তথ্য ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা হতে পারে। সেখানে গুলশানের কথাও বলা ছিল। গুলশানের ঘটনা ঘটার তিন মিনিটের মাথায় সেখানে পুলিশ পৌঁছায়। পুলিশ আধাঘণ্টার মধ্যে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু জিম্মিরা তখন কী অবস্থায় ছিলেন, সেটা বিবেচনা করতে হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। জঙ্গিদের হামলায় ১৭ বিদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জন মারা যান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নয়জন ইতালির নাগরিক ছিলেন।
জীবিত জিম্মিদের উদ্ধারে ২ জুলাই হলি আর্টিসানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে হামলাকারী ছয় জঙ্গিও নিহত হন।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশে পুলিশের বিশেষায়িত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিসি) ইউনিট দাবি করে, এটি নব্য জেএমবি নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের কাজ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আইএস মতাদর্শী আছে।
গুলশান হামলার সাতদিনের মাথায় শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলা করে জঙ্গিরা। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, এক নারী ও আক্রমণকারী জঙ্গি নিহত হন।
এআর/এমএমএ/এমএআর/পিআর