মাথাপিছু ৪৬ হাজার টাকা ঋণে শুরু হচ্ছে অর্থবছর
ঠিক এই মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হলো, আগামীকাল ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরে তারও মাথাপিছু ঋণ ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষ ৪৬ হাজার টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে শুরু করছে ২০১৭-১৮ অর্থবছর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট দিলেও বেশি আয় করতে পারছেন না। এতে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। আর তা মেটাতে তার ভরসা এখন ঋণ। এই ঋণ প্রতিবছরই বাড়ছে। এর ফলে জনগণের উপর ঋণের বোঝা বাড়ছেই।
তাদের মতে, এতে বাজেট শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে। বিশাল অংকের টাকাও খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। সুদ পরিশোধে এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে না হলে সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি রাখতে পারত।
এ দিকে গত ১ জুন বাজেট পেশের দিন প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেটের আকার বাড়ছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং সরকার বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা; যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
এর মধ্যে দেশের ভেতর থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
সদ্য সমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুরো দেশের মানুষের ওপর ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ ছিল। সুদসহ আগের বছরগুলোর মূল টাকাও সরকার প্রতিবছর পরিশোধ করে আসছে। পরিশোধ না হওয়া টাকা জমতে জমতেই ঋণের বোঝা এত বড় হয়েছে।
এ দিকে গত ৩০ মে দেশের জনসংখ্যার একটি হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএস আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসেবে আগামী অর্থবছর শেষে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ এবং মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে মাথাপিছু ঋণ ছিল ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিতে হচ্ছে। এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোতে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঠিক মতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে।
তিনি বলেন, একসময় দেশি-বিদেশি ঋণের হার ছিল অর্ধেক-অর্ধেক। বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি থাকে, সরকার তাই সে পথে যায় না। সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে।
সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য আহসান এইচ মনসুর আলাদা একটি বিভাগ গঠনের পরামর্শ দেন।
এ দিকে নতুন ভ্যাট আইন থেকে পিছিয়ে আসায় এলোমেলো হয়ে গেছে নতুন বাজেট। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। আর বেশি আয়ের ওপর নির্ভর করেই বিশাল একটি বাজেট তৈরি করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন অর্থমন্ত্রী ও সরকার। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল বাজেট পাসের সঙ্গে সঙ্গেই। এমনকি সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থবছরের জন্য পাস হওয়া ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা।
মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। সুদ পরিশোধের পুরো বরাদ্দ কোন কোন খাতে ব্যয় করা হবে, বাজেটে তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হবে সঞ্চয়পত্রের সুদে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে মেয়াদি ঋণের সুদে।
বাজেট সংক্ষিপ্তসারের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ দিতে বরাদ্দ রাখা আছে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ১৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে মেয়াদি ঋণের সুদ বাবদ।
যদিও ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) ৪৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অথচ চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এনএফ/এমএস