গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা মানছে না বিমান প্রশাসন
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) ভ্রমণে স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ বিমানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োজিত করা হচ্ছে। ফলে ভিভিআইপি ফ্লাইটে একের পর এক ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ৫ মার্চ জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বিমানের বেশকিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ভিভিআইপি ফ্লাইটের জন্যে কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু বিমান প্রশাসন সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে উল্টো তাদের কাউকে আরও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিউনিখ সফর উপলক্ষে শাহজালালে কর্মরত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আতিক সোবাহানসহ ছয় ব্যক্তিকে ভিভিআইপি`র নিরাপত্তা জনিত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে নিয়োজিত না রাখতে নির্দেশনা দেয়।
ওই তালিকায় থাকা সিকিউরিটি বিভাগের ম্যানেজার মো. নুরুজ্জামান মন্ডল (সম্প্রতি অবসরে গেছেন, পি নং- ৩২৬৫৯), একই বিভাগে কর্মরত মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম (পি নং- ৩৫১২৭), নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক মো. শহিদুল্লাহ খান (পি নং- ৩৫১৫৩), নিরাপত্তা সহকারী মো. কামরুজ্জামান (জি নং- ৫০৩৫৪) ও নিরাপত্তারক্ষী মো. আলমগীর হোসেনের (ডি নং- ১০৬২৯) নামও ছিল।
একই সংস্থার ৫ মার্চ ইস্যু করা অপর এক চিঠিতে ৬ থেকে ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর জাকার্তা সফর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে আতিক সোবাহানসহ আরও ১২ ব্যক্তিকে ভিভিআইপি`র নিরাপত্তা জনিত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে নিয়োজিত না রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেটিও আমলে নেয়নি বিমান প্রশাসন।
নির্দেশনায় আতিক সোবাহান ছাড়াও কেবিন ক্রু আশরাফুল হাসান (সি নং- ৩৭০২), পজিশনিং স্ট্যান্ডবাই ক্রু জুবাইদা গুলশান আরা (পি নং- ৩৫৫০৪), কেবিন ক্রু কাজী রিবিয়া সুলতানা কান্তা (পি নং- ৩৪৪২৮), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু নাহিদ সুলতানা তৃষা (সি নং- ৩৭৫৪), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু আকাশ (সি নং- ৩৭৬৮), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু হাসিবুল হক (সি নং- ৩৭৬৯), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু সিফাত (সি নং- ৩৭৩২), পজিশনিং ফ্লাইটের স্ট্যান্ডবাই ক্রু রাখি (সি নং- ৩৭২৫), স্ট্যান্ডবাই অপারেশন সহকারী ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম (পি নং- ৩২১৭৬), জিএসই বিভাগের অপারেটর মো. আমিনুল ইসলাম (পি নং- ৩৫৯৩৬) ও বিমান বিভাগের অপারেটর মো. আক্তার হোসেনের (পি নং- ৩৫৭২৪) নাম ছিল।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কালো তালিকাভুক্তদের সবার গ্রামের বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্বাসী মতাদর্শ প্রভৃতি বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হয়। এরপর তাদের ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার সেই নির্দেশনা এখনও মানা হচ্ছে না।
জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনার পর কয়েকজন কেবিন ক্রু`কে ভিভিআইপি ফ্লাইট থেকে বাদ দেয়া হলেও গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল পদে কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকেই বসিয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ মাস। আতিক সোবাহানকে দিয়েই ভিভিআইপি ফ্লাইটের খাবারের তালিকা তৈরির কমিটিও গঠন করা হয়।
বিমানের এ দৈন্যতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা জাগো নিউজের কাছে মুখ খুলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনার কারণেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আতিক সোবাহানকে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। বাকিদের বিষয়েও একই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে।
কারও বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি বলেও জানান তিনি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আতিক সোবাহানের বিরুদ্ধে ক্রু নিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে ক্যাজুয়াল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিএফসিসিতে (বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার) ভেটকি মাছের নামে সুরমা মাছ নেয়ার অভিযোগে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং এ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সময়ে দেয়া হয়েছে নানান সুবিধা।
বর্তমানে আতিক সোবাহান ঈদের ছুটি কাটাতে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এ কারণে তার ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল ফোনে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনার পরও ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের (গ্রাহক সেবা) মতো স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল জায়গা থেকে আতিক সোবাহানকে কেন সরানো হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের অবশ্য জবাব দেননি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
তবে তিনি বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর তার পদোন্নতি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) ইনামুল বারীকে গতকাল সোমবার বিকেলে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে মোবাইলের খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে তিনি জানান, জ্বরে আক্রান্ত। সুস্থ বোধ করলে রাত ৮টায় ফোন দেবেন। যদিও রাত ৯টায় ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মঙ্গলবারও তার কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অধিকতর স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে বিতর্কিত ব্যক্তিকে কেন রাখা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাব চাইতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদের মোবাইলে ফোনে কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে জানা যায় তিনি মেক্সিকোতে অবস্থান করছেন। এ বিষয়ে তার মন্তব্য চেয়ে একটি ই-মেইল বার্তা পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত তার পক্ষ হতে কোনো উত্তর দেয়া হয়নি।
আরএম/এমএআর/আরআইপি