ধর্মীয় উৎসবে বিভিন্ন দেশে পণ্যমূল্য কমলেও বাড়ে বাংলাদেশে
ধর্মীয় উৎসব বিশেষ করে রমজান উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্যের মূল্য সাধারণত কমে যায়৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে রমজান এলে প্রতিটি জিনিসের দাম কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র পুরোপুরি উল্টো।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিক মুনাফার আশায় প্রতি বছরই রমজানের আগে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে পাঁয়তারা চালান একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা এ অপতৎপরতা চালান।
সরকারের সঙ্গে বৈঠকে ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় নানা আশ্বাস দিলেও পরবর্তী সময়ে তা রক্ষা করেন না অধিকাংশ ব্যবসায়ী। রমজান, ঈদ বা পূজা এলেই খুচরা, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।
ফলে রমজান নাজাতের মাস হলেও সাধারণের কাছে এটি আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়েছে। কারণ তাদের জীবন-জীবিকা এ মাসে কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি স্বাভাবিকভাবে বিশ্ববাজারে যেসব নিত্যপণ্যের দাম কমে, এর প্রভাব আমাদের দেশের বাজারে পড়ে না। বরং ওইসব পণ্যের দাম বাড়তেই থাকে।
ছোলা
গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ছোলা ৭৪-৮৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ সপ্তাহে তা ১০-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৫-১১০ টাকায়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো মানের ছোলা প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ ডলারে। এ দর দীর্ঘদিন ধরে খুব একটা ওঠা-নামা করেনি।
ট্যারিফ কমিশনের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রমজান মাসে সারাদেশে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। আর সারাবছর এ চাহিদার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টন। ২০১৬ সালে দেশে মোট ছোলা আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার টন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এসেছে আরও ৫৬ হাজার টন, যা কিনা দুই বছরের চাহিদার চেয়েও বেশি। এরপরও রমজান মাস আসার বেশ আগেই ছোলার বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
চিনি
পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলাবাজারে চিনির দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে গত সপ্তাহে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হলেও চলতি সপ্তাহে তা ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনিতে বেড়েছে প্রায় ৪০০ টাকা। অথচ স্থিতিশীল রয়েছে অপরিশোধিত চিনির পাইকারি বাজার। আগের দর দুই হাজার ১০০ টাকায় তা বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজার স্থিতিশীল থাকার প্রধান কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই স্থিতিশীল রয়েছে চিনির দর।
ট্যারিফ কমিশনের বাজার মনিটরিং বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারের অপরিশোধিত প্রতি টন চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪২৫ ডলারে। এ হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির দাম পড়ে প্রায় ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা (এক ডলারের দাম ৮২ টাকা হিসাবে)। এর সঙ্গে ট্যাক্স ও আমদানি খরচ যোগ করে পাইকারি বাজারে এ চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪২-৪৩ টাকা। পরিশোধনের পর তা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৬৫ টাকায়।
সয়াবিন তেল
বিশ্ববাজারে গত বছরের অক্টোবরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৮৫৮ ডলার। দুই মাস না যেতেই আবারও দাম বেড়ে তা পৌঁছায় ৯১১ ডলারে (বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী)। যেহেতু বিশ্ববাজার থেকে অপরিশোধিত তেল এনে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করায় দেশে এ নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। জানা গেছে, দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে। লিটারপ্রতি ন্যূনতম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেয় বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো।
এদিকে কিছুদিন যেতেই বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমতে থাকে। ট্যারিফ কমিশনের আন্তর্জাতিক বাজার মনিটরিং সেলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৮০০ ডলারে। বেশ কিছুদিন ধরেই এ দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। তবে দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয়নি। এটিকেও স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, তবে বর্ধিত অবস্থায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল সর্বোচ্চ ৯৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দুই দফায় ১১.৩৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। আর পাঁচ লিটারের ক্যানে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৪.১২ শতাংশ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপণ্য যেমন- তেল, চিনি, মসুর ডালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। রমজানে এসব পণ্যের দাম বাড়ার তেমন কোনো কারণ নেই। বাস্তবতা হলো- অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনো যুক্তি মানছে না। তারা নানামুখী খোঁড়া অজুহাত তুলে দাম বাড়িয়ে চলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজান, ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে প্রতি বছর মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মুজদদারের আবির্ভাব ঘটে। এসব ব্যবসায়ী চিনি, ছোলা, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে থাকেন।
কথিত আছে, এ ব্যবসায়ীরা নাকি নিজেরাই বলেন, রমজানের এক মাস ব্যবসা করব, আর সারা বছর আরামে কাটাব! রমজান মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহর নিয়ামত এবং এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপমুক্তির মাস হলেও এ মৌসুমি ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাদায়ক।
অথচ রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমনকি ইউরোপের জার্মানিতেও রমজানের ব্যবহার্য সব পণ্য এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দেশগুলোতে বাজারে বিশাল মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পূজার সময় মূল্যহ্রাসসহ নানা প্রথা চালু আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যকরী পর্ষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু মজুদদার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনও কখনও পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেন।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে শুধু সরকারকে দোষারোপ করা হয়। এক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। তবে এটি ঠিক যে, সরকারের মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগে আর দ্রব্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হেয়ালিপনার কারণে কিছু মুনাফাখোর, মজুদদার, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়। এছাড়া ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও পরে ওই পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমলে তারা আর কমায় না।
এমইউএইচ/এমএআর/এমএস