পাটে ফের আশার আলো
একসময় পাট ছিল দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। রফতানি আয়ের সিংহভাগই আসতো পাট থেকে। পাট দিয়েই বাংলাদেশকে চিনতো বহির্বিশ্ব। নানা ঘটনা আর সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে পাটের সেই গৌরব।
তবে পাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাটের হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পাট খাতের ব্যবসায়ীদের কিছু নীতি ও অবকাঠামোগত এবং বাজার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সহায়তা দেয়া প্রয়োজান।
এদিকে, সরকারের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চলানো হচ্ছে। পাট শিল্পকে ‘কৃষিভিত্তিক শিল্প’ ও ‘কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। জুট প্যাকেজিং অ্যাক্ট করা হয়েছে। পাট থেকে ভিসকোচ (রেশম) উৎপাদনের লক্ষ্যে সবধরনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) কেউ পাট কারখানা করতে চাইলে সরকার থেকে জমি দেয়া হবে। দেশবাসীকে পাট ও পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনের লক্ষ্যে প্রতি বছর ৬ মার্চ ‘জাতীয় পাট দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাট দিয়ে দেশেই ভিসকোচ উৎপাদন করা গেলে পাটপণ্যে বৈচিত্র আসবে। ভিসকোচ হলো এক ধরনের রেশম, যা দিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। পাশাপাশি পাট দিয়ে পাল্প (মন্ড) ও পেপার (কাগজ) তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাটের চাষ বেশি, সেখানে পাল্প (মণ্ড) ও কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপন করলে সাশ্রয়ী মূল্যে পাট হতে পাল্প ও পেপার প্রস্তুতে পাটচাষী ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা সম্ভব হবে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ক্রেতারা অধিকহারে পরিবেশবন্ধব পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গ্রিন প্রডাক্ট, ন্যাচারাল প্রডাক্ট, ইকো ফ্রেন্ডলি প্রডাক্ট বা গো-গ্রিনের দাবি জোরাল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পাট বা কেনাফ জাতীয় ফাইবার হতে পারে পরিবেশবন্ধব প্রধান পণ্য। আর বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা মানের পাট উৎপাদান হয়। পাট উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, প্রথম ভারত। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে এর সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে শপিং ব্যাগের বার্ষিক চাহিদা ৫০ বিলিয়ন পিস উল্লেখ করে ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পরিবেশ সচেতনতা ও সবুজ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পাটের তৈরি শপিং ও ফুড গ্রেড ব্যাগ, কম্পোজিট, জিও-টেক্সটাইল, পাল্প ও কাগজের বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। টেক্সটাইল ফাইবার হিসাবে পাটের ব্যবহারের বাইরে টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের আওতায় জুট ফাইবার ব্যবহারের মাধ্যমে এ সেক্টরের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য উৎপাদান করে বাংলাদেশ বিশ্বের রফতানি বাজার ধরতে পারে। এক্ষেত্রে পর্দা, টেবিল ক্লথ, রানার, প্লেসমেট, কুশন কাভার, সোফার কাভার, কিচেন ওয়্যার, লন্ড্রি বাস্কেট, ফ্রুট বাস্কেট, স্টোরেজ প্রডাক্ট, হ্যাঙ্গার, ক্রিসমাস ডেকোরেশন সামগ্রী, গার্ডেনিং প্রডাক্ট, ফ্লোর কাভারিং প্রডাক্ট, শপিং ও ফ্যাশনেবল প্রডাক্ট, লাইফ স্টাইল ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে।
ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, বিশ্ববাজারে চটের ব্যাগের পাশাপাশি হোম টেক্সটাইল, গিফট অ্যান্ড হাউজওয়্যার প্রডাক্ট, ফ্যাশন এক্সেসরিজ অ্যান্ড লাইফস্টাইল প্রডাক্ট উৎপাদনে ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়ালস হিসাবে পাটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পাটপণ্য বহুমুখী করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ববাজর থেকে মোটা অংকের রফতানি আয় করা সম্ভব। এ জন্য ব্যবসায়ীদের নীতিগত, অবকাঠামো ও বাজার ব্যবস্থাপনা- এ তিন ধরনের সহায়তা দিতে হবে।
তিনি বলেন, নীতিগত সহায়তা হিসেবে সরকারের রফতানি নীতিতে বহুমুখী পাটপণ্যকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে উদ্যোক্তারা তাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারেন। পাশাপাশি বিশেষায়িত খাত হিসেবে সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা ছোট-বড় সবাই যাতে পান সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সম্ভাবনাময় বিভিন্ন বিশেষায়িত খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া বিশেষ ফান্ড (ইডিএফ)-এর আদলে বিশেষ ঋণ সুবিধার আওতায় পাটশিল্পকে আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের উন্নত টেক্সটাইল প্রযুক্তির আওতায় বিশেষায়িত বেশ কয়েকটি কম্পোজিট জুট মিল স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় উন্নতমানের ফেব্রিক উৎপাদান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি একই ছাতার নিচে উন্নতমানের কাঁচামালসহ উন্নতমানের ডায়িং ও লেমিনেশন সুবিধাসহ স্পেসালাইজড জুট মিল স্থাপন করতে হবে।
এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১০ মাসে (জুলাই ২০১৬ থেকে এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত) পাট ও পাটপণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৮২ কোটি ৬৫ লাখ ইউএস ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে আগের বছরের তুলানায় পাট ও পাটপণ্য রফতানি করে আয় বেড়েছে নয় কোটি ৬৬ লাখ ডলার বা ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।
বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকার ভিসকোচ আমদানি হয়। বাংলাদেশেই পাট থেকে ভিসকোচ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। একনেকের অনুমোদন নিয়ে আগামী দুই বছরের মধ্যে ভিসকোচ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি বলেন, প্রক্রিয়াগতভাবে পাট কৃষিপণ্যের আওতায় এনে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করবে। প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে গেলে পাটের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেককে ব্যাংকিং সুবিধাসহ কিছু না কিছু সুবিধা দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের মাত্র ১০ শতাংশ বীজ আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করি, বাকি ৯০ শতাংশ বীজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।
ডিসিসিআই (ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি পাট হতে পাল্প ও পেপার উৎপদানে মনোযোগী হলে আমরা আবারও পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে পারি। এ লক্ষ্যে পাট খাতে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলে ওয়াহিদ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাটের চাষ বেশি হয়, সেখানে পাল্প (মণ্ড) ও কাগজ প্রস্তুতকারী কারখানা স্থাপন করতে হবে। যার মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পাট হতে পাল্প ও কাগজ প্রস্তুতে পাটচাষী ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা সম্ভব হবে।
এমএএস/এমএআর/পিআর