অবকাঠামোর উন্নতি হলেও বিনিয়োগ তলানিতে
গত পাঁচ বছরে দেশের অবকাঠামো খাতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বদলায়নি বিনিয়োগের চিত্র। কোনোভাবেই বিনিয়োগের খরা কাটছে না। প্রতি মাসেই কমছে নিবন্ধন। এভাবে টানা কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগের দুর্দিন চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবায়নের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য অনুকূল পরিবেশের উপর দায় চাপানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, জমি রেজিস্ট্রেশন, ঋণের সুদের হার, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানীমূলক চার পর্বের নিবন্ধের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-
অবকাঠামো খাতে আমূল পরিবর্তন আনতে সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। মংলা বন্দরসহ দেশের স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের কাঁচা রাস্তাঘাট পাকা করা হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। আরও একটির কাজ চলছে। বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে আট বছরে এর উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।
তবে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট কাটাতে পারেনি সরকার। বিনিয়োগের জন্য এত আয়োজন সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ বাড়েনি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মোট ৫১০টি প্রতিষ্ঠান ৩৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন করিয়েছে, যা এর আগের তিন মাস অর্থাৎ গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে ৩১ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা কম। ওই সময় দেশে ৪৮৭টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।
আলোচ্য সময়ে যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে তা থেকে প্রায় ৭৪ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বিডা সূত্র জানায়, আলোচ্য তিন মাসে স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৬৯টি। এসব প্রতিষ্ঠান ২৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। বিগত অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে যা ২৯ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে ৪৪৪টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৩ হাজার ৪৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল।
জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশে ২০টি শতভাগ বিদেশি ও ২১টি যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে। তারা সাত হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, যা আগের তিন মাসের তুলনায় প্রায় ৫০৬ শতাংশ কম। অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে মোট ৪৩টি প্রতিষ্ঠান ৪৫ হাজার ৭২৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছিল। অবশ্য বিডা বলছে, আলোচ্য সময়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব ২০৫ শতাংশ বেড়েছে।
জানা গেছে, আলোচ্য তিন মাসে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেশি এসেছে সেবা খাতে, যা মোট বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ। এছাড়া রাসায়নিক শিল্প খাতে সাড়ে ১৭ শতাংশ, বস্ত্রশিল্পে সাড়ে ১০ শতাংশ, খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট খাতে সাড়ে ১২ শতাংশ, প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ২৩ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বিডায় নিবন্ধন নিতে হয়। নিবন্ধন নেয়ার পর বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো যে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তব বিনিয়োগে পরিণত হওয়া সময়সাপেক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। এছাড়া আস্থার সংকট থাকায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না। ফলে ব্যাংকগুলোর শিল্পঋণ বিতরণে মন্থর গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নেতিবাচক বিনিয়োগের বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ ইঙ্গিত। এর সঙ্গে জড়িত প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। টানা কয়েক বছর পর্যন্ত বিনিয়োগ কমছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও বিষয়টি স্বীকার করা হচ্ছে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজির পাচার বাড়তে পারে। কারণ কেউ টাকা ফেলে রাখে না।’
রফতানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অবশ্যই গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হবে। এ মুহূর্তে একজন শিল্পপতিও গ্যাস পাচ্ছেন না। বিদ্যুতের সংযোগ পেতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তাই উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ আসে দেশি বিনিয়োগের গতি দেখে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ না করলে বিদেশিরা সেদেশে বিনিয়োগে আসে না।’
জ্বালানি সুবিধা বাজেটে পলিসি লেবেলে রাখার দাবি জানান তিনি। বলেন, ‘জাতীয় গ্রিডে যখন বিদ্যুৎ জমা হবে তখন শিল্প খাতে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ দেয়ার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। শিল্প স্থাপন করলে গ্যাস পাবে এ রকম নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাহলে যেসব উদ্যোক্তা বিনিয়োগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত তারা বিনিয়োগ করবেন।’
ব্যবসায়ী এ নেতা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিরতা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ভালো নয়। আন্তর্জাতিক বাজার বর্তমানে খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ৪৮৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বাজার ৪৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তাই বিনিয়োগে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।’
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সহজীকরণ, সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও বৈষম্য দূরীকরণ- এ পাঁচ ইস্যুতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বড় বাধা বলে জানিয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাদের মতে, বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছতে হলে রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। নতুবা বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে না। এটি ছাড়া মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর পথও পিচ্ছিল হয়ে পড়বে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইইউ’র পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত সংস্থাটির রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন বলেন, ‘ইইউ মনে করে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হওয়া। ইইউ মনে করে, শুধু রফতানি দিয়েই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এর পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফবিআই) ও আমদানি দুটাই বাড়াতে হবে।
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর