ছয় কোটি শ্রমিকের জন্য ৭ আদালত
মিরপুরের এমকো ফ্যাশনে কাটিংমাস্টার হিসেবে কাজ করতেন মফিজুল ইসলাম। ১৯৯৪ সালের ৪ অক্টোবর তিনি এ প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কোনো নোটিশ ছাড়াই মৌখিকভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করেন। পাওনা মজুরির জন্য ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি, যা অদ্যাবধি নিষ্পত্তি হয়নি।
মাদারীপুরের নতুন শহর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহ্ জালাল। ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুর এলাকার সফটেক্স কটন (প্রা.) লিমিটেডে সুইং সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৪ সালের ২০ মার্চ প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার তাকে মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করেন। পরবর্তীতে লিখিত আদেশ এবং সে অনুযায়ী পাওনা দাবি করলে তাকে কারখানা থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে মজুরি আদায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় মালিকপক্ষকে নোটিশ করা হলেও তারা আদালতে হাজির হননি।
শুধু মফিজুল ইসলাম কিংবা জালালের মামলাই নয়। শ্রম আইনে দায়ের করা ১৬ হাজার মামলা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। যদিও আইন অনুসারে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করার কথা। তবে বিভিন্ন আইনি জটিলতায় এসব মামলা ৬০ মাসেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ছয় কোটি শ্রমিকের জন্য আদালত মাত্র সাতটি। আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলাজট দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে বড়লোকেরা যখন মামলায় হারেন তখন উচ্চ আদালতে আপিল করেন, সেখানে সাধারণ শ্রমিকরা যেতে পারেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব শ্রমিক শ্রম আইনের সুবিধা পান না এবং এ বিষয়ে জানেনও না। মামলাজট কমাতে দেশে আরও শ্রম আদালত গঠন করতে হবে। তাহলে এ আইনের সুফল পাওয়া যাবে।’
‘মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ ভাগ শ্রমিক আইনি সুরক্ষার বাইরে। এসব শ্রমিককে আইনের আওতায় আনতে হবে’ বলেও জানান তিনি।
মে দিবসের ইতিহাস
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। এ আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত ঘটনার মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিবসটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে দিনটি মহান মে দিবস হিসেবে দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১ মে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা, মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নেয়া হয়। এদিন সরকারি ছুটি।
প্রতি বছরের মতো এবারও মহান মে দিবস উদযাপনে শ্রমিক-মালিক ও সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে শিকাগোর ঘটনার ১৩১ বছর পরও এ দেশের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিগুলো কতটুকু আদায় করতে পেরেছে- সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
শ্রম আদালতের বেহাল দশা
নানা প্রতিবন্ধকতা ও আইনি জটিলতায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালসহ দেশের আটটি আদালতে বেহাল দশা পরিলক্ষিত হয়। আদালতগুলোতে অনেক সময় চেয়ারম্যান থাকেন না। আবার অনেক সময় সদস্যরাও (মেম্বার) থাকেন অনুপস্থিত। এতে কোর্ট গঠন হয় না। ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা বেড়ে যায়।
জানতে চাইলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অধীর চন্দ্র বালা জাগো নিউজকে বলেন, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালসহ সারা দেশের আটটি আদালতে মোট ১৬ হাজার আটটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে তিন হাজার ৭৫৫টি, ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে পাঁচ হাজার ৩৬৯, ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে তিন হাজার ৭৫৯, চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে এক হাজার ১০৩, চট্টগ্রাম দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৬৫১, খুলনা বিভাগীয় শ্রম আদালতে ৩৮৯, রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতে ২৪৮টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার মধ্যে ১১ হাজার ৮৭২টি মামলা ছয় মাসের অধিক সময় ধরে চলমান। এছাড়া উচ্চ আদালতের আদেশে ৩০৫টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
শ্রম আইনে মামলার দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রম আইনে মামলাসমূহ ৬০ দিনে নিষ্পত্তি করার নিয়ম। কিন্তু ৬০ মাসেও এসব মামলা নিষ্পত্তি হয় না। দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলাজট বাড়ছে এবং মামলা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী আদালতে দুজন সদস্য থাকেন। তাদের অনুপস্থিতির জন্য অনেক সময় মামলা বিলম্ব হয়। আবার অনেক সময় মালিক পক্ষের অনুরোধে আইনজীবীরা বিলম্ব করেন।’
কী আছে শ্রম আইনে
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর সংশোধনী প্রস্তাব ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২২ জুলাই বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩ নামে গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। নতুন ওই সংশোধন দ্বারা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩৫৪টি ধারার ৭৬টি সংশোধিত হয়েছে এবং নতুন ৬টি ধারা ও ৯টি উপধারা সংযোজিত হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩ ধারা ২ দফা ৬১-এর শিল্প স্থাপনার আওতায় জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, ওয়েল্ডিং, আউটসোর্সিং, মোবাইল অপারেটর অথবা মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাপ্রদানকারী ও ল্যান্ডফোন অপারেটর কোম্পানিসহ ১১টি নতুন উপ-দফায় বিভিন্ন শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পূর্বে শিল্প স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। তবে শ্রম আইনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো এ আইনে দেশের ৮০ ভাগ শ্রমিকের শ্রমের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। অর্থাৎ মোট শ্রমশক্তির সিংহভাগই শ্রম আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এতে অধিকাংশ শ্রমিকই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান খুবই লঘু। আর এর প্রয়োগও বিরল। যেমন- শিশু ও কিশোর সংক্রান্ত বিধানের লঙ্ঘন হলে শাস্তি মাত্র ৫ হাজার টাকা। এছাড়া আইএলও সনদ ১৮৯ ও হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে গৃহশ্রমিককেও ওই সংশোধনীতে শ্রমিক মর্যাদা দেয়া হয়নি। ২০১১ সালে বিচারপতি এম ইম্মান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের রায়ে সরকারকে গৃহশ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইনের শ্রমিক সংজ্ঞার আন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় এ আইন হয়নি। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়ে এ আইন সংশোধন করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থাকলে রানা প্লাজা-তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না।’
তিনি বলেন, ‘এক লাখ টাকা জীবনের ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে বিড়ম্বনা চলছেই। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে যে মৌলিক অধিকার নিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল আট ঘণ্টা সময় কাজ করা। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে আট ঘণ্টারও বেশি শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। আধুনিক যুগেও শ্রমিকদের দিয়ে মধ্যযুগীয় দাসের মতো কাজ করানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, “বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইন, ২০০৬ নামে যে আইন করেছিল তা শ্রমিকদের স্বার্থের পক্ষে ছিল না। বর্তমান সরকার আইনকে সংশোধন করে জাতীয় সংসদে শ্রম আইন (সংশোধন) ২০১৩ পাস করিয়েছে। এ সংশোধনীর পরও আইনটি ‘গণতান্ত্রিক শ্রম আইন’ হয়নি।”
জেএ/এএইচ/এমএআর/বিএ