বিজিএমইএ’র বীমা প্রতারণা!
বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প। এ খাতের শ্রমিকদের গ্রুপ বীমার সার্বিক বিষয় তদারকি করে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন- বিজিএমইএ। তবে সংগঠনটি শ্রমিকদের গ্রুপ বীমার ক্ষেত্রে শ্রম আইন ও বীমা আইন কোনোটিই মানছে না বলে অভিযোগ।
শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০০ শ্রমিক থাকলেই গ্রুপ বীমা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পোশাক তৈরি কারখানার মালিকরা তা মানছেন না। দুই বছর ধরে কোনো বীমা কোম্পানিতে পোশাক শ্রমিকদের গ্রুপ বীমা করা হচ্ছে না।
২০০৬ সালের শ্রম আইনে কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০০ শ্রমিক থাকলে গ্রুপ বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে ১০০ শ্রমিক থাকলেই গ্রুপ বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়।
এ বিষয়ে সংশোধিত শ্রম আইনের ৯৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে সকল প্রতিষ্ঠানে অন্যূন ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত রহিয়াছেন, সেইখানে মালিক প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ী গ্রুপ বীমা চালু করিবেন।’
আর ৯৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বীমা দাবির টাকা এ আইনের অধীন শ্রমিকের অন্যান্য প্রাপ্যের অতিরিক্ত হইবে; তবে শর্ত থাকে যে, শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বীমা দাবি আদায় মালিকের দায়িত্বে হইবে এবং মালিক উক্ত বীমা দাবি হইতে আদায়কৃত অর্থ পোষ্যদের সরাসরি প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’
আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না বিজিএমইএ। সংশোধিত শ্রম আইনের পর সংগঠনটি নতুন জীবন বীমা কোম্পানি সোনালী লাইফের সঙ্গে দুই বছরের গ্রুপ বীমার চুক্তি করে। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এরপর থেকে গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি কোনো বীমা কোম্পানিতে শ্রমিকদের গ্রুপ বীমা করেনি।
অবশ্য ২০১৪-১৫ সালে শ্রমিকদের জন্য যে গ্রুপ বীমা করা হয়েছিল তাও পূর্ণাঙ্গ ছিল না। সে সময় সব শ্রমিকের জন্য গ্রুপ বীমা না করে মাত্র ২৫ জনের জন্য এটি করা হয়। এসব শ্রমিক কারা- তাও নিশ্চিত করা ছিল না।
ফলে গ্রুপ বীমার নামে সংগঠনটি এমন চুক্তি করে, যা বীমা চুক্তির কোনো আওতায় পড়ে না। এর আগে সংগঠনটির এ ধরনের অভিনব চুক্তি ছিল ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মেটলাইফ আলিকো এবং জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে।
এর মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডেল্টা লাইফের সঙ্গে, ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মেটলাইফ আলিকোর সঙ্গে এবং এরও আগে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জীবন বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাত্র ২০ জন শ্রমিকের জন্য গ্রুপ বীমার চুক্তি করা হতো।
দুই বছর ধরে কোনো বীমা কোম্পানিতে গ্রুপ বীমা না করার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রুপ বীমা এখন চলে গেছে সরকারের হাতে। আমাদের ওয়েলফেয়ার ফান্ডের মাধ্যমে এটি সরকারের কাছে চলে যায়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রবিধি আছে ওখানে।’
‘যদি কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হন তবে ওই ফান্ড থেকে আমরা টাকা দিয়ে দেই। শ্রমিকের টাকা পাওয়া দরকার। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে টাকা দিলাম নাকি আমার পকেট থেকে দিলাম- এটা কোনো ব্যাপার না’ বলেন গার্মেন্ট মালিকদের এ নেতা।
তবে বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো বীমা কোম্পানিতে গ্রুপ বীমা না করে ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে শ্রমিকদের বীমার টাকা দেয়া বীমা আইন ও শ্রম আইন উভয়েরই লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান পদে চলতি দায়িত্বে থাকা গকুল চাঁদ দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো বীমা কোম্পানিতে গ্রুপ বীমা না করে ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে বীমার টাকা দেয়া আইনের লঙ্ঘন। কারণ বীমা কোম্পানিগুলো ঝুঁকি শেয়ার করে বীমা করে। যদি কোনো ইন্ডাস্ট্রি এ বীমা নিজে নিয়ে নেয় তাহলে তারা পুনঃবীমা করবে কীভাবে? আর ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে বীমার টাকা দেয়া কিছুতেই বিধিসম্মত নয়।’
প্রাইম ইসলামী লাইফের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও জীবন বীমা বিশেষজ্ঞ কাজী মোরতুজা আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফাঁকি দেয়ার জন্য অনেকে কো-অপারেটিভ ফান্ড, রিক্স ফান্ড করেন। এটি আসলেই বীমা কিন্তু বলে ফান্ড। আমাদের দেশের এনজিওরা এটি অহরহ করে যাচ্ছে। যদিও এটি আইনে পারমিট করে না।’
‘বীমা আইনে পরিষ্কার বলা আছে, শুধুমাত্র নিবন্ধিত বীমা কোম্পানি বীমা করতে পারবে। এনজিও, কোনো সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন কখনই বীমা করতে পারে না। সুতরাং তারা যেটি করছে আইনের দৃষ্টিতে সেটি কিছুতেই বৈধ বলা যায় না’- বলেন কাজী মোরতুজা আলী।
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, বীমা কোম্পানিতে বীমা করতে হবে। যদি কোনো ফান্ড থেকে বীমার টাকা দেয়া হয় তা আইনসিদ্ধ নয়।’
সোনালী লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিত চন্দ্র আইচ জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৪ সালে বিজিএমইএ আমাদের সঙ্গে দুই বছরের জন্য গ্রুপ বীমার চুক্তি করে। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এরপর আর কোনো বীমা কোম্পানির সঙ্গে তারা শ্রমিকদের গ্রুপ বীমা করেনি। এখন বীমার টাকা তারা নিজস্ব তহবিল থেকে দিচ্ছে।’
এমএএস/এমএআর/বিএ