জাগো নব প্রাণে নব আনন্দে
ফাগুনের আগুন চৈত্রে এসে তেজ বাড়িয়েছে বহুগুণ। সে আগুন মানুষের মন ছুঁয়ে প্রকৃতিতেও ছড়িয়েছে। তীব্র দাবদাহে জীবন যেন ওষ্ঠাগত। গরমে বসন্তের রঙ চৈত্রসংক্রান্তিতে অনেকটাই মিলে যাওয়ার মতো। গাছে গাছে পত্র-পল্লবের পূর্ণতা এসেছে বেশ আগেই।
ঋতুরাজ বসন্তের উদাস হাওয়া স্বাগত জানিয়েছে বৈশাখের ঝড়ো হাওয়াকে। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ ঈশানকোণে কাল বৈশাখীর মেঘরাশিও উঁকি দিয়েছে চৈত্রের শেষ বেলায়। যেন প্রকৃতিতেও চলছে বর্ষবরণের ধুম আয়োজন।
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা ১৪২৪ সন। পুরাতন বছরের জরাজীর্ণ দূর করে নতুনের কেতন উড়িয়ে বৈশাখ এসেছে বাংলাকে নবরূপ দিতে। বৈশাখের বাতাবরণে ধরণী অস্থির হলেও বাঙালির মন হয়ে ওঠে আরো যৌবনা। অতীতের সকল গ্লানি মুছে বাঙালি ফিরে পাবে নবপ্রাণ।
বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বর্ষবরণের মহা আয়োজনে মেতে উঠেছে গোটা দেশ। দেশের বাইরে থাকা বাঙালিরাও এতে শামিল হয়েছেন। হাজার বছরের ইতিহাসে বর্ষবরণের আবেগের কথা গেঁথে আছে মর্মে মর্মে। একেবারেই বাঙালির উৎসব বর্ষবরণে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির খাঁটি রূপ রূপায়িত হয়।
দিনটি ধরেই গ্রামের মানুষ এখনো তাদের জীবনপঞ্জিকা সাজায়। এদিন বাঙালি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে স্বজনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। নানা স্বাদের পিঠা-পায়েসে আপ্যায়ন চলে দিনভর। চলে পান্তা উৎসবের মহাযজ্ঞ। সাম্প্রতিক বছরগুলোত বৈশাখ উৎসবে যোগ হয় জাতীয় মাছ ইলিশও। তবে এ বছর পান্তা-ইলিশ নিয়ে চলছে জোর বিতর্ক।
বৈশাখী উৎসবের প্রধানতম আয়োজন বৈশাখী মেলা। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটিরশিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠাপুলির আয়োজন।অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এদিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির মতো জনপ্রিয় খেলাধুলা।
রাজধানী ঢাকার পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রমনা বটমূল। এখানে ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিকসন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রঙ-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা সূচনা বলে জানা গেছে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘বিশ্ব অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে ইউনেস্কো। ফলে এবার এটির গুরুত্ব আরো বেড়েছে।
ইতিহাস বলে বর্ষবরণের রূপায়নও রাজনৈতিক। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটেরআদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওচিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলাসনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এ গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবেরআয়োজন চলত। উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এ দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব খোলা। গ্রামেগঞ্জে হালখাতার রীতি এখনো বিদ্যমান।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপন ঘটে ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
এএসএস/এমএআর/বিএ