তিস্তা ইস্যুতে মানুষের ভরসা এখন প্রধানমন্ত্রী
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান। কূটনৈতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। নানা কারণেই এ সফর ঐতিহাসিক বলে মত দেন তিনি। আলোচনায় গুরুত্ব পায় দক্ষিণ এশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়েও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর উপলক্ষে নানা ইস্যুতে আলোচনা হচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর ঐতিহাসিক বলেই আমি মনে করি। বেশ কয়েকটি কারণে এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সফরের অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন। এটি নদীর প্রশ্নে নয়, তিস্তা এখন এ অঞ্চলের মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হচ্ছে, এটি সত্য। এর চেয়ে বড় সত্য, নদীতে পানি না থাকার কারণে সাগরের লবণাক্ত পানি উজানে চলে আসছে। এতে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। কৃষির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
জাগো নিউজ : ভারত তো বলে পানির সংকট সে দেশেও?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : হ্যাঁ, তারা প্রায়ই বলে সে দেশে পানি নেই; বাংলাদেশকে কীভাবে দেব? আমি মনে করি, এ কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করা। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, নদীপথে এমন কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না, যা অন্য কোনো দেশের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আন্তর্জাতিক এ আইনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সম্ভবত ভারতও স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে।
অসংখ্য তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, ভারত তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে মহানন্দা নদীতে প্রবেশ করাচ্ছে। সেখান থেকে গঙ্গা নদীতে পানি নিয়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে চাষাবাদের কাজে লাগানোর কথা রয়েছে। এটি মূলত ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পেরই অংশ।
জাগো নিউজ : কিন্তু আমরা কেবল তিস্তাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছি। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তো কোনো আলোচনা নেই।
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : তিস্তা এ মুহূর্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আইন বলেই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের অধিকার। তিস্তাকে একেবারে আলাদা করে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে এখনই সরব হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। আমি ঠিক বুঝতে পারি না ভারতের আদালত এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে তাগাদা দেয় কেমন করে? এটি আদালতের মোটা চিন্তার ফল বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ : এটি কেন মনে করছেন? আদালত তো সে দেশের স্বার্থেই তাগাদা দিয়েছে?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কোনো এক সময় ভারত-ই মরুভূমিতে পরিণত হবে। ৫০ বছর পর এ প্রকল্প আর কোনো কাজে আসবে না। নদীগুলো মরে যাবে। হিমালয়ের বরফ ভয়ঙ্করভাবে গলতে শুরু করেছে। এক সময় নদীতে আর পানি আসবে না। তখন এ প্রকল্প সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়বে।
জাগো নিউজ : প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে তিস্তা ইস্যু কতটুকু গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবার ভারত সফরে গিয়ে তিস্তা ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত। এজন্য দেশটির সরকারের সামনে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত হাজির করা দরকার। এ ইস্যুতে জনমনে আস্থা কমছে। অথচ ভারতের দুজন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে তিস্তা নিয়ে ইতিবাচক আশা দিয়েছিলেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘তিস্তা ইস্যুতে আমার ওপর আস্থা রাখুন।’
জাগো নিউজ : আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ভালো বলে মনে করা হয়।
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : হ্যাঁ, কতগুলো অঙ্গীকার এবং নীতির ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। যে অঙ্গীকার উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থে গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলাদেশ ভারতকে আশ্বস্ত করেছে, এ দেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতে কেউ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না, যা ভারতের অখণ্ডতার প্রতি বাংলাদেশের শ্রদ্ধা। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের মধ্যকার বিদ্রোহ প্রবণতাগুলো এখানকার মানুষ সহ্য করবে না এবং এটি আমাদের একটি সচেতন নীতি।
একইভাবে তিস্তা নিয়ে ভারতের কাছ থেকে আশ্বস্ত হয়েছিলাম আমরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের এ পথ ধরেই তিস্তার পানি আদায় করবেন বলে আশা রাখি।
জাগো নিউজ : তিস্তা নিয়ে শুধু অঙ্গীকারই মিলছে, পানি মিলছে না। এখনও ভরসা পাচ্ছেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : ভারতের সরকার বা সে দেশের আমলারা যে তিস্তা ইস্যু নিয়ে কতটুকু সিরিয়াস! এর কোনো ভরসা নেই। তবে ভারত নয়, তিস্তা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) যথেষ্ট ভরসা পাচ্ছে মানুষ।
জাগো নিউজ : কেন এমনটি মনে করছেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কূটনৈতিক অঙ্গনে একপ্রকার গতি এনেছেন। এক্ষেত্রে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ভারত সরকারকে এটি বোঝানোর ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা নিয়ে যে বাধা সৃষ্টি করেছেন, তা ঠিক নয়। এ বাধা কূটনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়েই দূর করতে হবে।
জাগো নিউজ : কিন্তু সে দেশের রাজ্য সরকারগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হয় এমন আলোচনায়…
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : মানুষ তাই জানে। কিন্তু এটি ভুল। ভারতের সংবিধানে সুস্পষ্ট বলা আছে, জাতীয় স্বার্থে বা নিরাপত্তার প্রশ্নে রাজ্য সরকারের চিন্তাধারাকে গৌণ বলে বিবেচিত হবে।
তিস্তা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার ইস্যু। জাতীয় নিরাপত্তা বলতে শুধু সামরিক খাতকেই বোঝায় না। আরও অনেক খাত থাকে। তিস্তা এমনই একটি খাত। ভারতের সংসদে এ মুহূর্তে বিজেপি সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তারা আইনসভার মাধ্যমে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কংগ্রেসের সময় এমন সংখ্যাগষ্ঠিতা ছিল না।
জাগো নিউজ : কিন্তু প্রচার আছে, বিজেপি থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক ভালো।
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : তা আছে বটে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’। এমন আশ্বাস গুরুত্ব দিয়েই সম্পর্কের ধারাকে উচ্চমাত্রায় নেয়া হয়েছে। কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রশ্নে নয়, জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে এখন সম্পর্ক নির্ণয় হচ্ছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : আপনি জাতীয় স্বার্থের কথা বলছেন। কিন্তু নেয়ার চেয়ে ভারতকে আমাদের দেয়ার পাল্লাই ভারি। তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন হলে এর বিনিময় কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : ভারতকে আমরা তুরুপের তাস দিয়ে দিয়েছি। ভারতকে আমরা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আশ্বাস দিয়েছি, যেটি ভারতের মিডিয়াও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে স্বীকার করেছে। তারা বলছে, সেভেন সিস্টার্স প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে, তার বিনিময়ে ভারতকে এখন এক পা, দুই পা করে এগোতে হবে।
ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রশ্নে বাংলাদেশ মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশে হামলা করতে পারত। তারা অনেক ক্ষতি করতে পারত। তারা বাংলাদেশের বাণিজ্য আরো কঠিন করে তুলতে পারত।
বাংলাদেশ এ প্রশ্নে যে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, সে কারণেই ভারতে বিজেপি সরকারের এমন সফলতা। সেখানে বিদ্রোহ প্রবণতা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। ভারতীয় বাহিনীও সেখানে বিশেষ স্বস্তি পাচ্ছে।
আমি মনে করি, সেভেন সিস্টার্স প্রশ্নে বাংলাদেশ অবশ্যই কৌশলগত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। রণকৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের যে কার্ড শো করার কথা, তা ইতোমধ্যে করে দিয়েছে। অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
কিন্তু আমরা ভারত থেকে শুধু আশ্বাসই পাচ্ছি। অবাক হই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জের ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেত্রীও যখন আশ্বাস দিয়ে বেঁকে বসেন।
জাগো নিউজ : আপনি ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে ঝুঁকির কথা বলছেন। বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে এ ঝুঁকি কতটুকু রয়ে গেছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান : প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ সীমানায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থাকছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রচুর গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন যে অবস্থান, তা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো কোনো বাস্তবতা নেই। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ভারতীয় বাহিনীও সজাগ রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গেও ভারত একটি সমঝোতামূলক সম্পর্ক তৈরি করেছে। (চলবে…)
এএসএস/এমএআর/এআরএস/আরআইপি