ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

অস্থির বাজার : রোজায় কী হবে?

প্রকাশিত: ০৬:২৯ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০১৭

মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান। আত্মশুদ্ধির এ মাস আসার আগেই বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ঈদ আর রোজা মানেই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি আর বেশি বেশি লাভ- দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে এমনটিই চলে আসছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং জাগো নিউজের পক্ষে সরেজমিন বাজার ঘুরে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাড়তি মুনাফার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। তবে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগেভাগেই বাড়ানো হচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। তাই বাজারে কোনো সুখবর নেই। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, আলু, খেজুর, মাছ, মাংস, মসলা, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। যদিও সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না। এ জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে (৩১ মার্চ, শুক্রবার) রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ও মুরগির দাম বাড়ানো হয়েছে। হালিপ্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। এছাড়া বাজারভেদে উঠা-নামা করছে চাল-ডাল ও পেঁয়াজ-রসুনের দাম। পাইকারি বাজারে গত সপ্তাহের চেয়ে আলুর দাম বাড়ানো হয়েছে ৪-৬ টাকা। খুচরা বাজারে বর্তমানে সাদা আলু বিক্রি হচ্ছে ২২-২৪ ও লাল আলু ২৫-২৬ টাকায়। বেড়েছে কাঁচামরিচের দামও। পাইকারি বাজারে ৪০ টাকা করে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকায়।

বাজারে ব্রয়লার মুরগি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে মুরগির প্রতি কেজির দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। গরুর মাংস কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৭০-৪৮০ টাকায়। খাসির মাংস ৮০০ টাকায়।

বাজারে মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। আবার কোথাও কোথাও গ্রাহক বুঝে মাছের দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি রুই ৩৬০-৪০০ টাকা, কাতলা ৪০০-৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৩০-২০০ টাকা, সিলভার কার্প ২০০-২৫০ টাকা, আইড় ৪৫০-৬০০ টাকা, মলা ৩২০-৩০০ টাকা, বোয়াল ৪৫০-৫০০ টাকা, মেনি মাছ ৩৫০-৪০০, বাইলা মাছ প্রকারভেদে ২৫০-৪০০ টাকা, বাইন মাছ ৪০০-৫০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ৪৫০-৮০০ টাকা, পাবদা ৫০০-৬০০ টাকা, পুঁটি ১৮০-২০০ টাকা, শিং ৪০০-৭০০ টাকা, দেশি মাগুর ৪০০-৭০০ টাকা, শোল মাছ ৩৫০-৫০০ টাকা, পাঙ্গাস ১৪০-১৬০ টাকা এবং চাষের কৈ ২০০-২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

গত সপ্তাহের চেয়ে সবজির দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে শিমের দাম ২০ টাকা। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৮-৩০ টাকায়। বাধাকপি ২৫-৩৫ টাকা, শালগম ২৫-৩০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, টমেটো ৩০-৪০ টাকা, গাঁজর ২০-৩২ টাকা, মূলা ২০-৩০ টাকা, শশা ও খিরা ২০-৩২ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার পিচ ১৫-২০ টাকা, বরবটি ৬০-৭০ টাকা, শালগম ২৫-৩০ টাকা, ঢেঁড়স ৫০-৬০ টাকা, কচুরলতি ৪০-৫০ টাকা, মটরশুটি ৫০-৬০ টাকা, কাঁচা কলা প্রতি হালি ২০-৩২ টাকা, লেবু প্রতি হালি ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর পাইকারি বাজার রহমতগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ছোলা ৭৪-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা এক মাস আগে ছিল ৬৮-৭০ টাকা। খেসারি ৬৫-৬৬ টাকা, ডাবলি ৩২ টাকা, মুগ ডাল ৯২-৯৫ টাকা এবং মসুর ডাল মানভেদে ৯৮ থেকে ১০৩ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে একই বাজারে তিন থেকে ছয় টাকা বেশি দরে খুচরা বিক্রি করছেন ক্রেতারা।

রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আসলাম নামের এক মার্কেটিংকর্মী জাগো নিউজকে বলেন, রমজান আসার আগেই ‘বাজার গরম’। বাজারের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ঘরে গিয়ে ব্যাগ দিলে গিন্নির চিৎকার, এটা আননি কেন, ওটা কই, এটা ছাড়া কি চলে, মসুর ডাল কই? এভাবে-তো চলতে পারে না বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

গত কয়েক মাস ধরে বেড়েই চলেছে চালের দাম। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম আবারও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের দোকানগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে একই মানের চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায়। এ হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপণ্যটির দাম কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে।

বাজারে মোটা চালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে মিনিকেটও। গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৪ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এর দাম কেজিপ্রতি ৪৮-৫২ টাকা ছিল। সপ্তাহের ব্যবধানে এটি কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে।

নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বি হলেও বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ)। একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারি সংস্থাটি। টিসিবিকে অকার্যকর করে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি চক্র। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি টিসিবিকে উদ্ধারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ।

তবে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ‘সুখবর’ দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শুভাশীষ বসু জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো এবারও আমাদের প্রস্তুতি চলছে। রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর মজুদ বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া টিসিবিতে প্রয়োজন মতো পণ্য মজুদ রাখা হচ্ছে। কোনো রকম সঙ্কটের সম্ভাবনা নেই।’

‘এবার কোনো ধরনের কারসাজির সুযোগ নেই’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হয় সেসব পণ্য এবার বেশি বেশি আমদানি করে মজুদ করা হচ্ছে।’

টিসিবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সালেহ মো. গোলাম আম্বিয়া জাগো নিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অংশ হিসেবে টিসিবি প্রতি বছরই উদ্যোগ নেয়। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতোমধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।’
বাজার চাহিদার কতটুকু টিসিবি পূরণ করতে পারবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের অংশগ্রহণ একবারে কমও নয়। জরুরি মুহূর্তে বা অন্য যেকোন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট।’

সরকারের সৎ ইচ্ছা থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব। এ জন্য সরকারকে অবশ্যই হার্ড লাইনে যেতে হবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার নিশ্চত করতে হলে সবার আগে জোর দিতে হবে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির ওপর। সারাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষার বার্তা পৌঁছে দেয়া জরুরি। সেটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একক প্রচেষ্টা কিংবা সক্ষমতা দিয়ে সম্ভব হবে না। সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে। পাশাপাশি সুধী সমাজকেও উদ্যোগী হতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেও।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তা হলো- বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি বন্ধ করা, সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্ভরশীলতা কমানো, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা- নিয়মিত তা তদারকি করা, দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং রমজান মাসে যে সব পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে জোগান দেয়া।

এমএআর/পিআর