হীরার টুকরো হাজারীবাগ!
বেশ কিছু দিন আগেও কোনো মানুষ হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকা দিয়ে একবার চলাচল করলে দ্বিতীয়বার ভুলেও ওই পথ পাড়ি দিত না। কারণ যত্রতত্র ট্যানারি বর্জ্যের চরম দুর্গন্ধ, নাকে রুমাল চেপেও উৎকট গন্ধে পথচলা ছিল দায়।
কিছু দিন আগেও কেউ হাজারীবাগে বসবাস করার চিন্তা করত না। এলাকাটি ছিল ট্যানারি শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। কিন্তু দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে এলাকার চিত্র। যে জমি বিনামূল্যে দিলেও কেউ নিতে চাইত না সেই হাজারীবাগ এখন হীরার টুকরোয় পরিণত হয়েছে। হীরার দাম দিয়েও মিলছে না হাজারীবাগের এক টুকরো জমি।
প্রায় ৭০ বছরের পুরনো হাজারীবাগের চামড়া শিল্পপল্লী। রাজধানী বুড়িগঙ্গার পাশ ঘেঁষেই গড়ে ওঠে এটি। চামড়ার দুর্গন্ধ নিয়ে বসবাস ছিল এ এলাকার মানুষের। চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য, লবণ ও অপরিশোধিত বর্জ্যের কারণে এ এলাকার আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র দুর্গন্ধ। নষ্ট হয় পরিবেশ, একই সঙ্গে নষ্ট হতে শুরু করে আশপাশের আবাসিক এলাকার বসবাসের পরিবেশ।
হাজারীবাগের পাশেই অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি। হাজারীবাগের চামড়া নগরীর বিরূপ প্রভাব ধানমন্ডি এলাকায়ও পড়তে শুরু করে। সবদিক বিবেচনা করে সরকার ও বিদেশিদের আর্থিক সহায়তায় এ শিল্পনগরী স্থান পায় সাভারে। এত দিন অনেকেই মনে করেছিল সাভারে যতই চামড়া শিল্পনগরী হোক না কেন, বাপ-দাদার করে যাওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই হাজারীবাগ ছাড়বেন না। কিন্তু সরকারের চাপে অবশেষে তারা বাধ্য হন হাজারীবাগ ছাড়তে। ঘোষণা দেন, সাভারে প্রতিষ্ঠিত চামড়া শিল্প নগরে প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের।
ব্যবসায়ীদের হাজারীবাগ ছাড়ার ঘোষণার পর এ এলাকার আবাসিক জমির গ্রাহক বেড়ে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জমির দাম- এমনটি জানান স্থানীয়রা।
তারা জানান, নব্বই দশকে এ এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির দাম ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কিছু দিন আগেও নামমাত্র খরচে বেচাকেনা হয়েছে আশপাশের জমি। কিন্তু হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানা যখন স্থানান্তরের ঘোষণা আসে, এরপর থেকে জমির দামে তারতম্য আসে। এক লাফে আকাশছোঁয়া দামে চলে আসে প্রতি শতাংশ জমি। বর্তমানে কোটি টাকায়ও এক শতাংশ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য ডেভেলপাররা এসব জমির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব হাজি করম আলী জাগো নিউজকে জানান, ৮-১০ বছর আগে হাজারীবাগের ট্যানারির আশপাশ এলাকার প্রতি শতাংশ জমি বিক্রি হতো নয় থেকে ১০ লাখ টাকায়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কোটি টাকায়। আগে জমি ছিল, ক্রেতা ছিল না। আর এখন ক্রেতা আছে কিন্তু বিক্রি করার মতো জমি নেই।
এদিকে জমির দামের পাশাপাশি বেড়েছে বাসা ভাড়াও। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্বাস উদ্দিন বলেন, ট্যানারি স্থানান্তরের খবরে গত তিন বছর ধরে এখানকার বাসা ভাড়া দ্বিগুণ বেড়েছে। আগে যে ফ্ল্যাট ছয় থেকে সাত হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত এখন তা ১০-১২ হাজার টাকায়ও মিলছে না।
ট্যানারি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত ঘটে। পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করে ১৯৫০ সালে হাজারীবাগের ট্যানারি অঞ্চলে আনা হয়। বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণে থাকা ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া ট্যানারি শিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে ট্যানারির সংখ্যা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণে থাকা ২১টি ট্যানারি বেসরকারি খাতে দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের পর ছোট ছোট কিছু ট্যানারি গড়ে উঠলেও বড় কোনো ট্যানারি গড়ে ওঠেনি।
গত ৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর সব কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফের বিষয়টি বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি ৯ এপ্রিল গ্রহণের কথাও জানান আদালত।
এর আগে পরিবেশ দূষণের দায়ে ২ মার্চ ১৫৪ ট্যানারির বকেয়া জরিমানা বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ১২ মার্চ হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারি কারখানা অবিলম্বে বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ট্যানারি কারখানাগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নের আদেশও বহাল রাখেন আদালত।
এর আগে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে বারবার আলটিমেটাম দেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী।
এসআই/এমএআর/পিআর