জঙ্গি ‘চ্যাপ্টার ক্লোজের’ চেষ্টা
সারাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান নেয়া জঙ্গিদের ‘চ্যাপ্টার ক্লোজ’ করতে বদ্ধপরিকর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গি দমনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, জঙ্গিদের ‘চ্যাপ্টার ক্লোজ’ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। এজন্য নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। জঙ্গিদের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা পেয়েছেন। জঙ্গি যত বড় বা দুর্ধর্ষই হোক না কেন তাদের ধরা পড়তেই হবে।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অভিযান থেকে তারা দেখেছেন, জঙ্গিরা সব সময় সঙ্গে গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখছে। পুলিশের প্রথম লক্ষ্য জঙ্গিদের গ্রেফতার করা। গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া। কিন্তু জঙ্গিরা পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও আত্মসমর্পণ করতে চায় না। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। এ কারণে পুলিশকে পাল্টা অভিযানে নামতে হয়। অভিযানের সময় জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করুক, পুলিশ সেটাই চায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া পরিচয়পত্র ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সুবিধাজনক স্থানে বাসা ভাড়া নিচ্ছে জঙ্গিরা। এমনকি বাড়িওয়ালাকে জমা দেয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য খতিয়ে দেখার আগেই পালিয়ে যাচ্ছে তারা। এ সময়ের মধ্যে জঙ্গিরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করারও চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি স্থানে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় এবং হামলায় হতাহতের ঘটনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি সারাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা মনে করছেন, শীর্ষ কয়েকজন জঙ্গি এখনও পলাতক, যারা পাল্টা হামলার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ কারণে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সব জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) জরুরি সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।
জরুরি সতর্কবার্তা পাঠানোর পরদিন সোমবার পুলিশ সদর দফতরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জাগো নিউজকে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় করণীয় বিষয়ে মূলত এ বৈঠক। তবে বৈঠকের সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা জানানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে। সবাই যেন সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি নাগরিক, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষ স্থাপনার সামনে জোর নজরদারিসহ দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শনিবার রাতে সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযানকালে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনার পর রাতেই দেশজুড়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা দেয় সদর দফতর। ওই বার্তায় জঙ্গি তৎপরতা রোধ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, দেশের বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সর্বাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়।
এদিকে সারাদেশের আদালত, বিচারকদের বাসভবন ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্কুলার জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত সার্কুলারটি ২৩ মার্চ জারি করা হয়।
কাউন্টার টেরোরিজম সূত্র জানায়, জঙ্গি আস্তানার সন্ধানলাভ এবং বিষয়টি তদন্তের পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সদস্যদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে এটি সম্ভব হচ্ছে। তবে বেশ কয়েকটি ঘটনায় জঙ্গিদের বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দেয়ার প্রমাণ মিলেছে। এটা নিজেদের পরিচয় আড়াল করার কৌশল বলে মনে করছে সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে গঠিত পুলিশের এ বিশেষ ইউনিট।
নিজেদের যতই আড়াল করার কৌশল অবলম্বন করুক, জঙ্গিদের ধরা দিতেই হবে- এমনটি দাবি করেছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৪ ডিসেম্বর আশকোনা এলাকার ‘সূর্য ভিলা’ নামের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। অভিযানে দুজন নিহত হন। তাদের একজন আজিমপুরে নিহত জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী, অন্যজন পলাতক জঙ্গি রাশেদুর রহমান সুমনের স্ত্রী শাকিরা ওরফে তাহিরা। জানা যায়, অনলাইন ব্যবসায়ীর পরিচয়ে আশকোনার বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা।
২০১৫ সালে বাড্ডার সাতারকুলের জিএম বাড়ি এলাকার ৭ নম্বর রোডের ৫৭৭ নম্বর বাড়ি থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পারেন, বাড়ির মালিক তাদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়ার সময় কোনো তথ্যই রাখেননি।
মিরপুরের শাহআলী এলাকার একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) শক্তিশালী গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ সাত জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। ছাত্র পরিচয়ে ওই বাসা তারা ভাড়া নেন। তাদের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কেও বাড়ির মালিকের কাছে কোনো তথ্য ছিল না।
নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি তামিম চৌধুরী, রাজধানী রূপনগরে জঙ্গি মেজর জাহিদ বাসা ভাড়া নিয়েছিল ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে। গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গিরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। শোলাকিয়ায় হামলার সাতদিন আগে শহরের নীলগঞ্জ সড়কে বাড়ি ভাড়া নেয় চার জঙ্গি। বাড়ির মালিক আবদুস সাত্তারের কাছে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র হিসেবে।
গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার দনিয়া রোডের পূর্ব দোলাইরপাড়ে একটি বাড়িতে নির্মাণ শ্রমিক পরিচয়ে জঙ্গিরা বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ১ ফেব্রুয়ারি ওই বাসায় তাদের পরিবার নিয়ে আসার কথা ছিল। সেখান থেকে জেএমবির আইটি প্রধানসহ গ্রেফতার হন জঙ্গি শাহীনুজ্জামান, মাহবুবুর রহমান, আশফাক-ই-আজম ওরফে আপেল ও আশরাফুল আলী।
১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বাড়ির মালিকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আটক হন জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আর্জিনা। সীতাকুণ্ড থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ইফতেখার হাসান বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে সীতাকুণ্ড পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকায় সাধন কুটিরে বাসা ভাড়া নিয়েছিল জসিম ও আর্জিনা। তাদের প্রকৃত নাম জহিরুল ও রাজিয়া। এর মধ্যে রাজিয়া রোহিঙ্গা। ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে জঙ্গি জসিমই দুটি বাড়ি ভাড়া নেয়।
ওইদিন সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার প্রেমতলায় ছায়ানীড় নামের আরেকটি বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হন। পরে ঘটনাস্থল থেকে বোমায় ক্ষত-বিক্ষত এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত চার জঙ্গির দুজনের নাম কামাল ও জোবায়দা। নিহত শিশুটি তাদের সন্তান। অন্য দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ছায়ানীড়ে অভিযান প্রসঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল মান্নান বলেন, পুলিশের খাতায় নিখোঁজ রাজধানীর মিরপুর এলাকার দুই খালাতো ভাই ছায়ানীড় আস্তানায় নিহত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জঙ্গিরা প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল বদলাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পেশাগত দক্ষতা দিয়ে তাদের দমনে সফল হচ্ছে।
সর্বশেষ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার একটি বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে। সেনা কমান্ডোদের অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’ পঞ্চম দিনের মতো অব্যাহত রয়েছে। সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে জানান, শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ চার জঙ্গির মরদেহ মিলেছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী। ধারণা করা হচ্ছে আতিয়া মহলের ভিতরে আর কেউ নেই। তবে অভিযান চলবে।
অভিযান চলাকালীন শনিবার সন্ধ্যায় দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ পরিদর্শকসহ ছয়জন নিহত হন। এছাড়া র্যাবের দুই কর্মকর্তাসহ আহত হন সাংবাদিক, পুলিশসহ ৪৬ জন।
‘আতিয়া মহল’ র মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী উস্তার আলী বলেন, ভুয়া পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। গত জানুয়ারিতে কাওসার আহমদ নামের এক ব্যক্তি বাসা ভাড়া নেন। তারা স্ত্রীর নাম মর্জিনা।
সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা বলিনি জঙ্গি নির্মূল হয়েছে। আমরা বলেছি জঙ্গিরা আমাদের কন্ট্রোলে রয়েছে। সিলেটের শিববাড়িতে প্যারা কমান্ডো বাহিনীর অভিযানের মধ্যে সংঘটিত বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশে আইএসের কোনো সদস্যকে ধরার সৌভাগ্য এখনো আমাদের হয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সারা দেশ চষে বেরিয়েছি। দেশের কোথাও আইএস শনাক্ত করার সৌভাগ্য হয়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোনো নেতাই আইএসের অনুসন্ধান দিতে পারেননি। যদি আইএস শনাক্ত করতে পারতাম তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতাম।
সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় বড় কোনো জঙ্গি নেতা রয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো অভিযান চলছে, অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে বড় কোনো নেতা থাকতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, গোয়েন্দারা বাড়িটি চিহ্নিত করতে পেরেছে বলেই অভিযান চালানো সম্ভব হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জনগণ জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না, সেহেতু তারা টিকতে পারবে না।
ভুয়া তথ্য দিয়ে জঙ্গিদের বাড়ি ভাড়া নেয়া প্রসঙ্গে ডিএমপি’র (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ডিএমপিতে ডাটাবেজ সিস্টেম চালু হওয়ায় জঙ্গিরা এখন রাজধানীতে বাসা ভাড়া নিতে পারছে না। এছাড়া সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও মনিটরিং থাকায় বাড়িওয়ালারাও সতর্ক।
তিনি বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে সফটওয়্যারভিত্তিক ডাটাবেজ শুরু হওযার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৪৯টি পরিবারের নিবন্ধন ডাটাবেজে সংরক্ষণ করেছে ডিএমপি। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের উপরে।
অপরাধীদের ধরতে ও নিরাপত্তার স্বার্থে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া ও মেস সদস্যদের তথ্য নিবন্ধন আরও জোরদার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। একই সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পরিলক্ষিত হলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানায় তথ্য দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি। বলেন, জঙ্গিদের পালিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাদের ধরা দিতেই হবে।
জেইউ/এমএআর/পিআর