মার্চ এলেই একাত্তরে ফিরে যান ফুটবলার মনি
আমরা হারবো না হারবো না, তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না- মাতৃভূমি আর দেশের জন্য যুদ্ধে এমন পণ থাকে বীর সেনাদের । আবার দেশের হয়ে খেলতে নেমে প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চি জায়গা না দেয়ার প্রতিজ্ঞাও থাকে খেলোয়াড়দের। দুই ক্ষেত্রেই দেশের জন্য লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে তার। রণাঙ্গন আর ফুটবল মাঠে বুক চিতিয়ে দেশ ও দলের জন্য আত্মনিয়োগ করা সে বীরের নাম মো. মজিদুল ইসলাম মনি।
১৬ বছর বয়সে দেশের জন্য যুদ্ধের ময়দান আর ২৫ বছর বয়সে জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল মাঠ কাঁপানো পাবনার এ কৃতি সন্তান সবসমই রয়ে গেছেন প্রচারের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধা আর ফুটবলার হিসেবে দেশের জন্য লড়াই করা এই নায়ককে মনে রাখেননি কেউ। তদবির আর তৈলমর্দন করে অনেক অখ্যাত ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিভিন্ন পুরস্কার বগলদাবা করে ফিরলেও মনি থেকে গেছেন অবহেলিতই। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ না থাকলেও জাগো নিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে একটি প্রশ্ন যেন তার মুখ দিয়ে বের হলো মনের অজান্তেই, ‘ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের যে পুরস্কার থাকে তার মাপকাঠি কি?’ দেয়া যায়নি তার এ প্রশ্নের উত্তর।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স, আজাদ স্পোর্টিং, রহমতগঞ্জ আর চট্টগ্রাম কাস্টমসের হয়ে। জাতীয় দলেও সার্ভিস দিয়েছেন ৫ বছর। ১৯৭১ সালে যেমন দেশের মাটি রক্ষার্ জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশের দোসরদের বিরুদ্ধে, ফুটবল মাঠেও তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন রক্ষণভাগে। দুই ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষকে রোখা ছিল তার কাজ।
৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য নানা মানুষের নানাভাবে অবদান আছে। ক্রীড়াঙ্গনেও অনেক মানুষ আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন বিভিন্নভাবে। তবে মনির মতো কিশোর বয়সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার পর জাতীয় দলেরই জার্সি গায়ে খেলেছেন এমন উদাহরণ হাতেগোনা। রণাঙ্গনের পর ফুটবল মাঠ কাঁপানোর মজিদুল ইসলাম মনি বছরের দুটি মাস এলে ফিরে যান পেছনের স্বর্ণালী দিনগুলোতে- একটি মার্চ, আরেকটি ডিসেম্বর। বিশেষ করে মার্চ এলেই তিনি ফিরে যান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে।
‘জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত- এ দুটি জিনিস আমাকে বেশি আবেগময় করে তোলে। যখন মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে ভারতে ট্রেনিং করতাম, তখন আমরা প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন আর জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শুরু করতাম। সে কথা মনে করে এখনো আমার গা শিহরিত হয়ে উঠছে। মার্চ আর ডিসেম্বর এলে বউ-বাচ্চাদের একাত্তরের ঘটনা বলি, যা ওদের কাছে সবচেয়ে গর্বের গল্প’- জাগো নিউজকে বলেন মনি।
আপনি তো একদম প্রচারের অন্তরালে। কেউ আপনাকে চেনেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, কেউ ফুটবলার হিসেবে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে সেই দেশেরই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে লড়াই করেছেন ফুটবল মাঠে- এ সম্মিলিত গল্পটা জানা নেই অনেকেরই। নিজেকে কী লুকিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করেন?
‘আসলে এসব নিয়ে ভাবি না। আমি যা পেয়েছি তা কয়জনের ভাগ্যে জোটে? অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছি। আবার সেই দেশেরই জার্সি গায়ে সেবা দিয়েছি। এর চেয়ে বড় পাওয়ার কি আছে? আমি যখন অবসরে পরিবারের সদস্যদের এসব গল্প করি তখন তাদের বলি, যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছি তখন আমার জায়গায় আমি সেরা ছিলাম। আবার যখন জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি তা ওই পজিশনে সেরা ছিলাম বলেই। কর্মজীবনেও আমি সফল। একটা মানুষের আর কি চাই? আমার বড় গর্ব তো ওখানেই’- জবাব মজিদুল ইসলাম মনির।
ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থেকে দেশের শীর্ষ ক্লাব আর জাতীয় দলে খেলার গল্প নতুন নয়; কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার গল্প তো একটু আলাদাই। ৭১ সালের সেই গল্প শোনা যাক দু:সাহসিক সেই মনির মুখেই- ‘আমি তখন পাবনা জেলা স্কুলে দশম শ্রেনীর ছাত্র। তখন রাজনীতি সম্পর্কে আমার তেমন গভীর ধারণা ছিল না। তবে রাজনৈতিকভাবে আমাদের স্কুলটি ছিল ওই সময় খুবই আলোচিত। স্কুল মাঠে ছাত্রলীগের মিটিং, সভা-সমাবেশ বেশি হতো। আমাদের বাড়ী স্কুলেরই পাশে। সে হিসেবে প্রায় প্রতি বিকেলেই ওই মিটিং, সভায় উপস্থিত থাকতাম। ৩ মার্চের জাতীয় অধিবেশন বাতিল হওয়ার প্রতিবাদে বিশাল একটা মিছিল হয়েছিল। সেখানে আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পরদিন থেকেই স্কুল মাঠে খালি হাতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়, সেখানে ট্রেনিং নিতে থাকি। ২৬ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাবনা আক্রমন করলে পরের দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ মিলে তাদের প্রতিরোধ করা হয়। ওই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই মারা যায় এবং কিছু পালিয়ে যায়।’
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে দুইবার পড়শি দেশ ভারতে গিয়েছিলেন মনি, ‘এপ্রিলে একবার ভারত গিয়ে ফিরে আসি। আবার যাই মে মাসে। আমরা এক সঙ্গে ১৩ জন ছিলাম। কুষ্টিয়া হয়ে ভারতে গিয়ে আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। শিয়ালদাহ স্টেশনে নেমে দেখি ওখানে কোনো ক্যাম্প নেই। আমাদের কাছে তেমন কোনো টাকা-পয়সাও ছিল না। এক পর্যায়ে ৭ জন আমাদের কিছু না বলে আলাদা হয়ে যায়। দুই রাত ওই স্টেশনেই ঘুমালাম। রুটি-কলা খেয়ে কোনোরকম দিন কাটাতাম। একদিন স্থানীয় একজন জানালেন পাশেই ত্রাণ অফিস আছে। সেখানে যাওয়ার পর চিড়া-গুড় পেলাম। এভাবে থেকে কয়েকদিন পর সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে আসার। মালদা-ভোলারহাট হয়ে ৩ দিন হেটে পাবনা ফিরে এলাম। পরিবার থেকে আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি বাড়ীতে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ সেখানে নেই। জানতে পারলাম তারা গ্রামে চলে গেছেন এক আত্মীয়র বাড়িতে। সেখানে গিয়ে কয়েকদিন থাকার পর এপ্রিলের শেষের দিকে জানতে পারলাম ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। আমার খালাতো ভাইয়ের ছেলে মিলে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে মাঝ রাতে পালিয়ে গেলাম। চারদিন হেঁটে কুষ্টিয়ার মিরপুর সীমানা দিয়ে ভারতের করিমপুর গেলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় বাস স্ট্যান্ডে একটি বাসের সিটে ঘুমালাম। পরের দিন কেচুয়াডাঙ্গা নামক একটি স্থানে ক্যাম্পে গেলাম। আমি সবার জুনিয়র ছিলাম বলে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পাবনা থেকে যারা ওই ক্যাম্পে যোগ দেন তাদের নাম লিপিবদ্ধ করার’- ট্রেনিং করতে ভারতে যাওয়ার গল্প বলছিলেন মনি।
ট্রেনিং শেষ করে জুনে দেশে ফিরেছিলেন মনি। এসেই দায়িত্ব পান পাবনার ঈশ্বরদী থানার। ওখানে তিনি স্থানীয়দের ট্রেনিং দিতেন। ভারত থেকে যে অস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন মনি সেটি দিয়েই সবাইকে ট্রেনিং দিতে থাকেন। ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করার পাশাপাশি মনি অনেক সিনিয়রদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
দু’বার পাকিস্তান সেনাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মনি। থাকতেন ঈশ্বরদীর শাহাপুর নামের একটি গ্রামে। দিনে থাকতে একটি বাড়িতে, বের হতেন রাত ১০টার পর। যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ির একটি ছেলের মাধ্যমেই তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ওই গ্রামের ৩/৪ কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। মনির খবর জানতে পেরে একদিন দিনের আলোতেই ওই গ্রামে ঢুকে পড়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাকিস্তান বাহিনীর ভয়ে মানুষ তখন ছোটাছুটি করছিল। সেই মানুষের মধ্যেই অস্ত্র হাতে গ্রাম থেকে বের হতে পেরেছিলেন মনি। হানাদার বাহিনী ওই বাড়িতে গিয়ে ব্যাপক তল্লাশি এবং ভাঙচুর করে।
পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে মনির ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন ছিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, ‘পাকিস্তান আর্মির একটি গাড়ী পাবনা শহরে ঢুকে গিয়েছিল। আমরা ৬ জন মিলে তাদের উপর হামলা করি। ওই অপারেশনে আমাকেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। কারণ, ৬ জনের মধ্যে সবচেয়ে ভারি অস্ত্র এলএমজি ছিল আমার কাছে। ওই অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয়ের খবর পেলাম তখন আমি পাবনা শহরেই ছিলাম। আনন্দে আমরা সবাই অস্ত্র উপরে দিকে তাক করে ফাঁকা গুলি ছুড়েছিলাম’- শেষ অপারেশনের বর্ণনা দেন মনি।
ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি টান ছিল তার। ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও অ্যাথলেটিক ও হকিও খেলেছেন। আন্তঃজেলা অ্যাথলেটিকে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। হকিতে আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় অধিনায়কত্বও করেছেন।
১৯৭২ সালে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন পাবনা বুলবুল কলেজে। সেখান থেকে ৭৪ সালে এইচএসসি পাশ করে মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সাধারণ ইতিহাসে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নবম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায়ই তিনি পাবনায় স্থানীয় লিগে খেলেছেন পাড়ার ক্লাব সবুজ সংঘের হয়ে। জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৮ ও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন। ঢাকায় ওয়াপদায় খেলা বাচ্চু নামের এক ফুটবলার মনির খেলা দেখে তাকে নিয়ে আসেন। তখন ওয়াপদার কোচ ছিলেন স্কটল্যান্ডের স্যান্ডি। তিনি তাকে ক্লাবে শুধু অনুশীলনের সুযোগ দেন মনিকে।
‘ওয়াপদায় ওই সময় হামিদ নামের একজন ফুটবলার ছিলেন। তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে চলে যান এবং আমাকেও যেতে বলেন। তার মাধ্যমেই আজাদে গিয়ে ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে লিগে প্রথম ম্যাচ খেলি। ৭৮ সালে ব্রাদার্সে যাই, থাকি ৮০ সাল পর্যন্ত। ৮১ থেকে ৮৩ সাল পর্যন্ত খেলি আবাহনীতে। তখন কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আশীষ, আসলাম, পাকির আলি, জনি, গোলাম রাব্বানী হেলালরা খেলতে আকাশী-নীল দলে। ৮৪ সালে যোগ দেই মোহামেডানে। ৮৫ সালে কাস্টমসে চাকুরি নিয়ে খেলতে থাকি চট্টগ্রাম লিগে। ৮৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে এসে রহমতগঞ্জের কিছু ম্যাচ খেলেছি’- ঢাকার ফুটবলে খেলার স্মৃতি রোমান্থন করলেন মনি।
১৯৮০ সালে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলেছেন। জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে ৮১ সালে। যুব ও জাতীয় দলের হয়ে থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর করেছেন তিনি। কাস্টমসের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। বর্তমানে থাকেন ঢাকার মিরপুরে। সময় পেলেই ঘরোয়া ফুটবল দেখতে ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। নিজের পরিচয় না দিয়ে চুপিসারে টিকিট কেটে বসে পড়েন গ্যালারিতে। গত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের আবাহনী ও শেখ জামালের ম্যাচও দেখেছেন জাতীয় দলের সাবেক এ স্টপার।
দেশের ফুটবল দিন দিন পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিন পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করেছেন, ‘আমাদের দেশের ফুটবলের গল্পটা সেই কচ্ছপ আর খড়গোশের মতো। অন্যরা পিছিয়ে থেকেও ধীরে ধীরে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে আমাদের আগে চলে গেছে। আমারা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দল বা ক্লাবের সঙ্গে খেলতে নামার আগে ভাবতাম কয় গোলে জিতবো। এখন আমরা হার এড়াতে পারি না। আসলে জেলার খেলা বন্ধ হওয়ার পরই পিছিয়ে পড়তে থাকে বাংলাদেশের ফুটবল। বাংলাদেশের ফুটবল জাগবে না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে ফুটবল তার হারানো গৌরব ফিরে পাবেই। সে প্রত্যাশা নিয়েই প্রতি রাতে ঘুমোতে যাই, সকালে ঘুম থেকে জাগি।’
আরআই/আইএইচএস/আরএস