আত্মদানের ইতিহাস আর কেউ বিকৃত করতে পারবে না
ডা. নুজহাত চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটি ও প্রজন্ম একাত্তরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী ছিলেন চোখের ডাক্তার। চোখের ডাক্তার হলে মা খুশি হবেন এ কারণে তিনিও হয়েছেন চোখের ডাক্তার ।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে হলেও এখন থেকে ২৫ মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত হওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ডা. নুজহাত চৌধুরী। শহীদ পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে তিনি মনে করেন জাতীয়ভাবে গৃহীত এ সিদ্ধান্তের ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকে এখন আর কেউ বিকৃত করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণহত্যা দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ তৈরি হলো বলে তিনি মনে করেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ডা. নুজহাত চৌধুরী তার এ অনুভূতির কথা জানান। তিনি বলেন, জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনের ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারবে। সুস্থ ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজম্ম মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্মান করতে শিখবে।
ডা. নুজহাত চৌধুরী মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর বাবা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে হারান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় আল-বদর বাহিনী ড. আলীমকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। সারারাত নির্যাতনের পর ভোরে তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। ডা. আলীমের বুকে অনেকগুলো গুলি ও সারা শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বাম দিকে ও তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ডা. নুজহাত চৌধুরীর কাছে তাঁর বাবার স্মৃতি ধূসর। মা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও পবিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে বাবা সম্পর্কে জেনে বড় হয়েছেন। বাবার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুনে এখনও নীরবে কাঁদেন। গণহত্যা দিবস পালন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতদিন জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত না হলেও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদের পরিবারের সদস্যরা গত দুই যুগেরও বেশি সময় যাবৎ দিবসটি পালন করে আসছেন। প্রতি বছর ২৫ মার্চ কালরাত্রি স্মরণে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে জগন্নাথ হল পর্যন্ত যান। এ দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি বিগত বহু বছর যাবৎ তাদের সম্মিলিত দাবি ছিল।
তিনি জানান, যেকোনো দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানাতে হলে সেই দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা অন্যতম পূর্বশর্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় না থাকায় গণহত্যা দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়নি। সুষ্ঠু ইতিহাস চর্চার অভাবে পাক বাহিনীর আন্তর্জাতিক মিত্ররা ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগ পর্যন্ত গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের মুসলিম স্কলার খেতাব দিয়েছে। এত বড় জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব তোলার দুঃসাহস দেখিয়েছে।
ডা.নুজহাত বলেন, এর আগে আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি চাইলে অনেকেই জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত না হলে তাদের তেমন কিছু করার নেই বলে এড়িয়ে যেত। জাতীয়ভাবে পালন শুরু হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় পরবর্তী সময়ে যেসব বন্ধু প্রতিম দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল সেসব দেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে দাবি আদায় করার প্রচেষ্টা চালানো যাবে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কিছুটা হলেও দুঃখ লাঘব হবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এমইউ/ওআর/এমএস