সারি সারি লাশ দেখে দম বন্ধ হয়ে গেল
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সভাপতি, বা্ংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২৫ মার্চ সেই ভয়াল কালরাত্রির সাক্ষী তিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পৈশাচিকতা। যুদ্ধের দামামা বাজছে জেনে গণহত্যা ঠেকাতে নিয়েছিলেন বিশেষ পরিকল্পনাও। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাত্রের সেই নির্মমতার স্মৃতিকথা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।
জাগো নিউজ : ২৫ মার্চ কোথায় ছিলেন, কী দেখেছিলেন, সেদিন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ১ মার্চের পর আমরা শহীদ মিনারে বিকেলে নিয়মিত সমাবেশ করতাম। সেসব সমাবেশ থেকে পরের দিনের জন্য সকলের কাছে নির্দেশাবলি ও করণীয় জানিয়ে দেয়া হতো। ২৪ মার্চ দুপুর থেকেই শহরে এক প্রকার আতঙ্ক, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। রাতে কিছু একটা হবে তা অনুমান করা যাচ্ছিল। আমরা ওই সমাবেশ থেকে সবাইকে সতর্ক করে দেই এবং সমাবেশ সমাপ্ত করি।
জাগো নিউজ : ২৫ মার্চ সকালেও সমাবেত হওয়ার কথা ছিল, আপনাদের…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : হ্যাঁ, পরদিন নিয়মিত সময় বিকেল ৪টার বদলে সকাল ১০টায় সমবেত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমি হল ছেড়ে হাতিরপুলে একটি বাসায় গিয়ে অবস্থান নেই। সন্ধ্যায় গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
গণহত্যা ঠেকাতে আমাদের কাছে ব্লু প্রিন্ট ছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল, আর্মি মুভ করার আগেই, ঢাকায় ঢোকার পথে যে কালভার্টগুলো আছে তা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে। আমি টেলিফোনে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম যে, আমরা কী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবো? তারা সম্মতি দিলেন।
জাগো নিউজ : এরপর…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। হাতিরপুলের ওই বাসায় শিল্পী কামরুল হাসান ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও ছিলেন। কালভার্ট উড়িয়ে দেয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার তর্ক লেগে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তি দিলেন, কালভার্ট উড়িয়ে কোনো সমাধান হবে না বরং হাতিরপুল এলাকা রক্ষা করাই আমাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। আমরা যুক্তি দিলাম, পুরো ঢাকা দখল হয়ে গেলে হাতিরপুলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে কী? তাই, গোটা ঢাকা শহর রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাগো নিউজ : পরে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : মীমাংসা না হওয়ায় আমরা আমাদের কর্মীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দেশনা দিয়ে দিলাম। ককটেল বানানোর জন্য দুই ড্রাম কেরোসিন ও পেট্রোল, কয়েক’শ কাচের বোতল এবং কিছু কাপড় নিয়ে আমি যে বাসায় উঠেছি, সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতির আগেই আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। রাত ১১টার দিকেই পাকিস্তানি সেনারা শহরে প্রবেশ শুরু করে এবং রাত ১২টার পর অপারেশন আরম্ভ করে দেয়।
হাতিরপুলের পাশ দিয়ে একটি রেললাইন ছিল এখন যেটি কাঁটাবন রাস্তা। রেললাইনের দুই পাশে বস্তি ছিল। পাকিস্তানি সেনারা বস্তিগুলো জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের পাশেই একটি তিনতলা ভবন ছিল। ওই ভবনের ছাদ থেকে আগুন এবং মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। মাথার ওপর দিয়ে অসংখ্য গুলি চলে যাচ্ছিল। কঠিন এক ভয়ার্ত পরিবেশ। তখন আমরা বুঝতে পারলাম আধুনিক একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না এবং আমাদের আরও প্রস্তুত নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে যেতে হবে।
জাগো নিউজ : পেট্রোল কেরোসিন কী করলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : হাতিরপুলে এখন যেখানে কাঁচাবাজার সেখান থেকে আর্মি ফায়ার করছিল। পাশেই একটি টিনশেড বাড়িতে আমাদের অবস্থান। তল্লাশি হতে পারে এ আশঙ্কায় রাতেই আমরা কেরোসিন, পেট্রোল বালতিতে করে ড্রেনে ফেলে দিলাম। বোতল, কাপড় সরিয়ে ফেললাম। বুঝলাম, এ উপকরণ দিয়ে কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এতে আরও বড় বিপদ ডেকে আনা হবে।
জাগো নিউজ : পরের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সমাবেশের কী হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশনের পর ঢাকা শহরের চিত্র পাল্টে যায়। চারদিকে হত্যা আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মানুষ দিশেহারা। সম্ভাব্য সেনা অভিযানের ব্যাপারে ধারণা যা মনে মনে ছিল, তা যে কত কাঁচা তা বুঝতে পারলাম। সত্যি কথা, সেনা অভিযানে যে এমন হত্যাযজ্ঞ হবে তা কল্পনা করতে পারিনি। মধ্যরাত থেকেই কারফিউ চলছিল। বাইরে বের হলেই গুলি করা হচ্ছিল। বস্তি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় সমাবেশের কথা চিন্তাই করতে পারিনি। কারফিউ চলাকালীন দু’দিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
জাগো নিউজ : হাতিরপুলের বাসাতেই থেকে গেলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : দু’দিন সেখানেই ছিলাম। এর পরে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হলো। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে গেলাম। সারি সারি লাশ দেখে দম যেন বন্ধ হয়ে গেল। এরপর পার্টির অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হলো। তারা সর্বোচ্চ শক্তি সঞ্চয় করতে বললেন এবং আপাতত নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বললেন। এরপর বাড়িতে গেলাম এবং ছোট একটি ব্যাগে লুঙ্গি, গামছা, ব্রাশ নিয়ে বের হলাম। সেই বাসায় আবার ফিরে এসেছিলাম ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের বেশে। তখন সেই ব্যাগ এবং আমার ব্যক্তিগত স্টেনগানটি অতিরিক্তভাবে আমার সঙ্গে ছিল।
জাগো নিউজ : নিরাপদ জায়গা কোথায় পেলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমি ঢাকার অদূরে ত্রিমোহনী (খিলগাঁওয়ের পেছনে) এলাকায় চলে গেলাম। এর আগের বছর ওই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে টানা এক মাস ত্রাণ বিতরণের কাজে নিয়োজিত ছিলাম। সেখানকার প্রতিটি বাড়িই আমার পরিচিত ছিল। পার্টির অন্য নেতাদেরও থাকার ব্যবস্থা করলাম। এখানে তিন-চার দিন থাকলাম। এরপর পার্টির পক্ষ থেকে নির্দেশনা এলো, চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিতে হলে ভারতে আশ্রয় নিতে হবে এবং ত্রিমোহনী এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হলো।
জাগো নিউজ : ত্রিমোহনী ছেড়ে কোথায় গেলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমরা নরসিংদীর মনোহরদীতে গিয়ে সেখানকার এক গ্রামে একজন কমরেডের বাসায় এক সপ্তাহ থাকলাম। সেখান থেকে আবার রায়পুরা থানার একটি গ্রামে গিয়ে পার্টির নেতাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। সেখানে কমরেড মণি সিং, কমরেড ফরহাদ প্রমুখ পার্টির নেতারাও ছিলেন। নেতাদের পরামর্শ এবং নির্দেশনা নিয়ে পরের দিন ভোর বেলা আখাউড়া সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলা চলে গেলাম।
জাগো নিউজ : এরপর...
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমরা প্রথমে আগরতলার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে যাই। এরপর আগরতলার কলেজ হোস্টেলে অবস্থান নেই। পরে ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপের আরও সদস্য চলে আসলে আগরতলায় ক্রাফট হোস্টেল নামে একটি হোস্টেলে উঠি।
জাগো নিউজ : প্রশিক্ষণ কি সেখানেই নিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যে বাহিনী (এফএফ) সেখানে প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের নেয়া হতো না। স্থানীয় এমপি বা এমএলএ’র সুপারিশ ছাড়া কেউ এফএফ বাহিনীতে ঢুকতে পারত না। শুধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সুযোগ পেত। তবে খালেদ মোশাররফ গোপনে আমাদের কাউকে কাউকে সুযোগ দিয়েছিলেন। এ জন্য প্রশিক্ষণ নেয়া খুবই কঠিন ছিল।
এএসএস/এমএআর/আরএস