বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে ১০০ কোটি মানুষ
পৃথিবীর ৭১ শতাংশ পানি থাকলেও এর মাত্র ৩ শতাংশ পানি খাবার যোগ্য। যার বিরাট অংশই অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে বরফ হিসেবে অথবা মাটির নিচে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ পানি মানুষের ব্যবহার উপযোগী। এসব তথ্য উঠে এসেছে জার্মানির পোটসড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে রয়েছে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ তালিকায় আরও ৫০ কোটি মানুষ যোগ হবে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বাড়ছে। এজন্য বিশ্ব যুদ্ধ লাগারও সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থাই নেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্টের (সেরিদ) জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পানির তেমন উৎস নেই বললেই চলে। রাজধানী ঢাকায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ও শীতলক্ষ্যা ছিল প্রাকৃতিক পানির উৎস। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, স্থাপনা নির্মাণ, কলকারখানা ও শিল্প বর্জ্য ফেলার কারণে এসব নদীর পানি চরম মাত্রায় দূষিত এবং ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীগুলোতে দূষণের মাত্রা এমন স্থানে পৌঁছেছে যে, মাছসহ জলজ প্রাণী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।’
তিনি জানান, শুধু দূষণের কারণেই পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ পানি হলেও তা খাবার বা ব্যবহারের উপযোগী নয়। তিনি আরও বলেন, পানি দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শিল্প কারখানার বর্জ্য। এছাড়া গৃহস্থালি, পয়-নিষ্কাশন, পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যও নদী দূষণের জন্য দায়ী। সেজন্যই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যেরও সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় নদীগুলোর পানি ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’
মানুষের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সুপেয় পানির চাহিদা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ঢাকায় মাটির নিচে পানির স্তর নিচে নেমে যাবার চিত্র ভয়াবহ।
তথ্যমতে, ১৯৮০ সালে যেখানে পানির স্তর ছিল ৫৬ ফুট নিচে। ২০১০ সালে তা নেমে যায় ২০৮ ফুটে। প্রতিবছর গড়ে পানির স্তর নামছে ৭ ফুট করে। আর ২০১৭ সালে কত ফুট নিচে গেলে পানি পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানে নগরীর প্রয়োজন মেটাতে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে প্রতিবছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে ঢাকার পানির স্তর।
পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং উত্তরণের উপায় না বের করতে পারলে আগামী ১৯ বছর পর পানির অভাবে আমাদের এই ঢাকা ছাড়তে হবে। তাই পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো যেমন-নদী, খাল ও জলাশয়গুলো সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহৃত পানির পুনর্ব্যবহার জরুরি।
ঢাকার আশপাশের নদীগুলো দূষিত হওয়ায় বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা মুন্সিগঞ্জের পদ্মা নদীর লৌহজং উপজেলার জশলদিয়া এলাকা থেকে পানি এনে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে শোধনাগার স্থাপন করছে। ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার। কিন্তু অর্থের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এর বাইরে মেঘনা থেকে ১০০ কোটি লিটার পানি আনার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মেঘনার এই পানি আসবে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার দিয়ে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। ভয়াবহ দূষণের ফলে দূরের নদীগুলো থেকে পানি আনলেও ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালু নদীর পানি বেশি করে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা ওয়াসা নিতে পারছে না।
এনভায়রমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে নতুন করে আরও প্রায় ৪৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র পানি সঙ্কটে পড়বে। দেশে পানির প্রধান উৎস নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পুকুর ও জলাশয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব মতে বর্তমানে দেশে প্রায় ৩১০টি নদী আছে। যেখানে এক হাজারের বেশি নদী ছিল। যা নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য অশুভ সংকেত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ, মৌলিক ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য চাহিদার জন্য প্রতিজনে দৈনিক ২০ লিটারের মতো বিশুদ্ধ পানি প্রয়োজন হয়। পানি সঙ্কট মোকাবিলা ও পানির যোগান নিশ্চিত করতে সব প্রকার পানির উৎস নদী নালা, খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয়ের দূষণ প্রতিরোধ ও ভরাট বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্টের (সেরিদ) নির্বাহী পরিচালক জুয়েল রানা জাগো নিউজকে বলেন, দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের উপর উচ্চ কর আরোপসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি আবাসন প্রতিষ্ঠানের নদী-খাল ভরাট করার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের প্রকল্পের পাশে ভবন নির্মাণের পাশাপাশি জলাধার নির্মাণে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। এটি মূলত সাংস্কৃতিক চর্চা, যার ভেতর দিয়ে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। এছাড়াও ওয়াসার পানি ব্যবস্থা ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। পানির ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, দরকার পানি ব্যবহারে সচেতনতা এবং বৃষ্টির পানি ধরে সেটা পুনর্ব্যবহার উপযোগী করা।
এমএসএস/এমআরএম/জেডএ/আরআইপি