ভালো নেই দৌলতদিয়া পল্লীর যৌনকর্মীরা
পদ্মার নির্মল হাওয়া দ্বারে এসে আছড়ে পড়ছে। তাতে আবার বসন্তের গন্ধ। এ পাড়ায় কারও কারও ভোর হয় বেশ আগেই। আগের দিন দোল উৎসব ছিল। পাড়ার অনেকেই মেতেছিল রঙ মেলান্তি খেলায়। স্নান সেরে রাঙা প্রভাতেই পাড়ার গলিপথ দখলে নিয়েছে ওরা।
ভোরের আভা নিভে সূর্যের কিরণ তীর্যক রূপ নিতেই খুপড়ি ঘরগুলোর দ্বার উদাম হচ্ছে। ততোক্ষণে পাড়ার গলিগুলোতে যেন পরীর মেলা বসেছে। হাঁসি, তামাশা, খুঁনসুটি চলছে হরদম। আবার অশালীন, অস্রাব্য ভাষায় খিস্তিও (গালমন্দ) কাটছে কেউ কেউ। মিলছে গেল রজনীতে ঘরে থাকা বাবুদের (খদ্দের) নানা কথাও। কোন বাবু কত বকশিশ দিল, কোন বাবুর স্ত্রী কেমন-এমনই আলাপে ওরা একেবারে জমিয়ে তুলছে।
পাড়ার মধ্যখানে একমাত্র খাবার হোটেল। খুপড়ি ঘরগুলোর সঙ্গে মেলানো যায় হোটেলটির কাঠামো। ভাত মিলছে সকাল বেলায়ই। হরেক রকম ভর্তা থরে থরে সাজানো। তবে ডাল-পরোটা জুটছে চাহিদা মতো।
হোটেলের চারদিক পুরোই উদাম। ঝাঁপি তুলে একেবারে খোলামেলা করা হয়েছে। পাড়ার কেন্দ্র মূলত এটিই। পাশেই জুয়ার বোর্ড। হাক ছাড়ছে জুয়াড়িরা। এর আশপাশ ঘিরেই কয়েকটি ডিসকো ঘর। তাতে একাধিক বিছানা পাতা। বাবুদের আয়েশের জন্য আছে কোলবালিশও। সেখানে মদ মিলছে, মিলছে বাইজি নাচও। যারা নাচছে, তারা পাড়ার-ই যৌনকর্মী। খদ্দেরের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা থাকলেই কেবল এমন নাচ দেখায় ওরা।
হোটেলে বসলেই গোটা পাড়ার রূপ নজর কাড়ে। হোটেলটির চারদিকে দাঁড়িয়েই ওরা খদ্দেরদের নজরবন্দি করছেন।
সময় গড়িয়ে সকাল ৮টা তখন। কয়েকজন মধ্যবয়সী থাকলেও অপেক্ষাকৃত তরুণীদের দখলেই পুরুষের এই রঙমহল। মধ্য বয়সীরা বেশির ভাগই প্রিন্টের সুতি শাড়ি আর স্বল্প আকৃতির ব্লাউজ পরা। কম বয়সীদের বসন বেশির ভাগ-ই সালোয়ার-কামিজ। গেঞ্জি, প্যান্ট, শর্ট স্কার্টও আছে কারও কারও পরনে।
সাজ বেলায় যে ওরা উদাসীন নয়, তা প্রত্যেকের রূপেই প্রকাশ। রঙচটা মেকআপ বদনজুড়ে। বসনের সঙ্গে মিলিয়ে লিপিস্টিক। লিপিস্টিকের রঙে মিলিয়ে কপালে ছোট-বড় টিপ। কড়া পারফিউম, যেন নিশিকালে কামিনী ফুলের সুভাস বইছে। বাহারি দুল শোভা মিলছে কানের লতিতে। কারও কারও কানে একাধিক রিং। মন মাধুরী মিশিয়ে চুল বেণি করতে যে বেশ সময় নিয়েছে ওরা, তা গাঁথুনি দেখেই ঠাওর করা যাচ্ছিল। বয়সীরা বেশির ভাগই খোপা বাঁধা। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি বাজছিল কারও কারও হাঁটার তালে।
অঙ্গ সাজের কোনোই ঘাটতি নেই ওদের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়োজনের কমতি নেই দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীতে। তবে এত আয়োজনের মধ্যেও ভালো নেই তারা। আগের মতো আর খদ্দের মিলছে না এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এ যৌনপল্লীতে। সময় গড়াচ্ছে আর দেহ ব্যবসায় ভাটা পড়ছে এখানকার কর্মীদের।
চায়ের দোকানে বসে পল্লীর নানা বিষয়ে আলাপ হয় রিতা নামের এক কর্মীর সঙ্গে। চল্লিশের ঘরে পা রেখেছেন রিতা। মেয়ে পিংকিকে (১৯) বাসে তুলে দিয়ে এসে চা-সিগারেট খেতেই বসা এখানে। পরিচয় দিয়ে আলাপ তুলতেই বলেন, ‘নটী (যৌনকর্মী) গো কথা শুনে কী করবেন? সাম্বাদিক (সাংবাদিক) গো লগে গপ্প (গল্প) করলে তো পেটে ভাত যাইব না। দেখলেন না, মেয়েরে ঢাকায় পাঠালাম (পাঠালাম)। ঢাকার হোটেলে কাজ করলেই ভালো বকশিশ পায়। ঢাকার বাবুরা আর এহানে আইতে চায় না। দিনে দিনে খদ্দের খালি কমতাছে।’
আলাপের মধ্যখানে যোগ দেন নিশা নামের আরেক যৌনকর্মী। ৯ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাচার হয়ে আসা নিশার ঠিকানা মিলেছে দৌলতদিয়া ঘাটের এ পল্লীতে। এখানেই তিন সরদারনীর হাত ঘুরে বিক্রি হয়েছেন তিনবার। এখন নিজেই ঘর ভাড়া নিয়ে কাজ করেন।
বলেন, ‘আমরা আর আগের মতো ভালো নেই। মানুষ ভালো থাকলেই তো আমরা ভালো থাকি। দেশের অবস্থা তো আমরাও কিছুটা বুঝতে পারি। বাজারে গেলেই মানুষের পকেট খালি হয়ে যায়। এনে (এখানে) ফূর্তি করতে আইতে তো ট্যাকা লাগে। দিনভর অপেক্ষা করেও দুজন বাবু মেলাতে পারি না। যারা আহেন তারা আর আগের মতো বকশিশও দেয় না। গতর খেটেই দিন পার।’
এএসএস/জেডএ/এএইচ/জেআইএম