বেকারত্বের শঙ্কায় হাজারীবাগের ঠেলাচালকরা
মো. ইসমাইল হোসেন। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। পেশায় ঠেলাগাড়ি চালক। রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় ঠেলাগাড়িতে ট্যানারির চামড়া বহন করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। কিন্তু হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলে বেকার হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন তিন সন্তানের জনক ইসমাইল।
সোমবার জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ উদ্বেগের কথা জানান ইসমাইল।
তিনি বলেন, ‘আগে ঠেলাগাড়িতে চামড়া টেনে মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হতো। এখন কাজ অনেক কমে গেছে। চামড়া আসছে কম। গত মাসে আয় হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়েই কোনরকমে পরিবারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘আমার তিন সন্তান। দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। মেয়ে ছোট। এখনো স্কুলে ভর্তি করিনি। তিন হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে কোনরকমে পরিবার নিয়ে থাকি। ঠেলা চালিয়ে যে আয় হয় তা দিয়েই বাসা ভাড়া, পরিবারের খাওয়া, ছেলে-মেয়ের খেলাপড়ার খরচ চালাতে হয়। শুনছি হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারে নিয়ে যাওয়া হবে। এটি যদি সত্যি হয় তাহলে তো বেকার হয়ে যাব। কিভাবে সংসার চালাব?’
তিনি জানান, হাজারীবাগে ট্যানারির চামড়া আনা-নেয়ার কাজের জন্য প্রায় দেড় হাজার ঠেলাগাড়ি আছে। এক একটি ঠেলাগাড়িতে ৭ থেকে ১০ জন কাজ করেন। সে হিসেবে হাজারীবাগ ট্যানারি ঘিরে প্রায় ১০ হাজার ঠেলাচালক আছেন। সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলে এসব শ্রমিকের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়বেন।
হাজারীবাগের কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেলো, বিভিন্ন স্থানে শতাধিক ঠেলাগাড়ি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। মূলত কাজ কমে আসাতেই একসময় সারাদিন ব্যবহৃত ঠেলাগাড়িগুলোর এখনকার এ দশা। একটি স্থানে এভাবেই ফেলে রাখা গোটা বিশেক ঠেলাগাড়ি, তার ওপরে বসে কথা হয় মো. আলম নামে আরেক শ্রমিকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘ভাই যেকোনো সমস্যার প্রধান শিকার হয় গরিব মানুষ। গরিব মানুষের কথা ভাবার সময় কারও নাই। সবাই বড়লোকদের কথা চিন্তা করে। এই দেখেন হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি নিয়ে গেলে কারখানার মালিকদের তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার মতো অনেক ঠেলাচালক বেকার হয়ে যাবে। অনেককে তখন না খেয়ে থাকতে হবে। এরইমধ্যে আমাদের আয় অনেক কমে গেছে।’
আরেক ঠেলাচালক বলেন, ‘কারখানায় যারা চাকরি করেন, তারা নির্দিষ্ট বেতনে কাজ করেন। কাজ করলে টাকা পাই, না করলে টাকা নাই না। সারাদিন কাজ করে একজন ঠেলাচালকের আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ টাকা দিয়েই আমাদের পরিবার চালাতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগে অল্প টাকায়, মানে ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বাস ভাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু যা শুনছি, সাভারে থাকার জায়গা নাই। তাহলে আমাদের পক্ষে হাজারীবাগ থেকে সাভারে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে না। আমাদের হয়তো বেকার হয়ে যেতে হবে।’
ট্যানারি শিল্প হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হলে ঠেলাচালকদের অবস্থার কী হবে এসব বিষয়ে আলাপ হয় হাজারীবাগ ঠেলাগাড়ি বহুমূখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুকের সঙ্গে।
ফারুক বলেন, ‘হাজারীবাগে প্রায় ১০ হাজারের মতো ঠেলাচালক আছেন। যাদের আয়ের একমাত্র পথ ট্যানারির পণ্য বহন করা। এখানে ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ হাজারীবাগে চামড়ার সঙ্গে জড়িত প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান আছে। এরমধ্যে বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান সাভারে চলে যাবে। কিন্তু আমরা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ পাই।’
তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগের ট্যানারির ওপর নির্ভর করেই হাজার হাজার ঠেলাচালকের জীবিকা চলে। এটা বন্ধ হয়ে গেলে অনেক ঠেলাচালকদের না খেয়ে দিন কাটাতে হবে। তাই সরকারের কাছে দাবি ট্যানারি স্থানান্তরের পাশাপাশি ঠেলাচালকদের বিকল্প একটি কাজের ব্যবস্থা করার।’
পরিবেশ রক্ষায় রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী রাজধানীর অদূরে সাভারের হেমায়েতপুরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সব ট্যানারি স্থানান্তর করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এ লক্ষে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কাঁচা চামড়া হাজারীবাগে ঢোকা নিষেধ করা হয়। এতে কার্যত বেকার হতে বসেছেন হাজার হাজার ঠেলাগাড়ি চালক।
এমএএস/এসআর/এআরএস/জেআইএম